প্যালেষ্টাইন–ইসরাইল, ইরান–ইরাক, কুয়েত–সৌদি আরব এর সংঘাতের কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন সময়ে সংকটের মধ্যে পড়েছে–যা এখনো চলমান। তেমনি ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের কারণে সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয় যে কোন মুহূর্তে সামরিক সংকটও তৈরী হতে পারে।
মায়ানমার যেভাবে বাংলাদেশের পূর্ব সীমানায় আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে, সেটা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢলে শুধু টেকনাফই নয়, বরং সমগ্র কক্সবাজারেই আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট দেখা দিয়েছে। বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম তারপরও অভ্যন্তরীণ সকল সমস্যা ছাপিয়ে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধই বর্তমানে টেকনাফের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সংকট। ২০২৩ সালে এসে গৃহযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়, যখন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করে। ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারির দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আরাকান আর্মি, রাখাইনে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। এদিকে, থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হচ্ছে আরাকান আর্মি, যাদের লক্ষ্য আরাকান বা রাখাইন রাজ্য স্বাধীন করা। মিয়ানমারের রাখাইনে গৃহযুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তের ওপারের এলাকা এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। আরাকান আর্মির দখল সামলাতে তাতমাডো বাহিনী রাখাইনকে মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে রাখাইনে তীব্র খাদ্য, জ্বালানি, ও নিরাপত্তা সংকট, ও মোটাদাগে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিকদেরও। কিন্তু আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবির কোনো প্রকাশ্য যোগাযোগ নেই। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে যে যে পতাকা বৈঠক হয় বিজিবি এখন সেটি করতে পারবে না আনুষ্ঠানিকভাবে। অন্যদিকে, দেশের নয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত মিয়ানমার প্রশ্নে পরিবর্তন এসেছে। রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। রাখাইন রাজ্য মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রাজ্যের রোহিঙ্গা, আরাকানীসহ সকল গোষ্ঠীই বাংলাদেশের সহায়তার ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমানা নিয়ে এখন বড় কোনো বিরোধ নেই। খোলাচোখে দেখলে মনে হবে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো বড় প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে সবসময় একটা ঠাণ্ডা লড়াই লেগে থাকে। একসময় তিনবিঘা ও বেরুবাড়ি নিয়ে উত্তেজনা ছিল। পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানি ও হাইড্রোইলেকট্রিক বাঁধ নিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিরোধ অনেক পুরোনো। এসব বিরোধ আলাপ–আলোচনার মধ্যেই মেটানো হয় কিংবা বছরের পর বছর আলোচনা চলতে থাকে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশ যেমন ভারতের ওপর দারুণভাবে ক্রুদ্ধ, তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় ভারতও খুব বিরক্ত। আমাদের দুই দেশেই অস্বস্তির ব্যাপার হলো সীমান্ত সমস্যা, পানি সমস্যা ও সাম্প্রদায়িকতা। এই সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। ভারতের আচরণের একটি দিক হচ্ছে নিজ দেশে মুসলিম বিরোধী নীতির চর্চা ও অন্যদিকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাদের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা। ফলে আমাদের দেশে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে এর প্রভাব পড়ে। একটা বিষয় সত্য, ভারত সরকারের মুসলমানবিরোধী নীতিমালার জন্য, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় ভারতের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট। ভারত সরকার তাদের মুসলমানবিরোধী কর্মকাণ্ডকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রচার করেন। কিন্তু এ নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের মানসিক অস্বস্তির দিকটা তারা কখনো ভেবে দেখেনি। কিন্তু এই দুই দেশে সংখ্যালঘুরা বিপদে পড়লে এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে দুই দেশেই পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে আরেকটা অস্বস্তি হলো ইগো বা অহংবোধ। সার্বিকভাবে ভারত আমাদের চেয়ে বড় দেশ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে শক্তিশালী, তাই তাদের অহংবোধ প্রবল। তাই বলে তাদের এই অহংবোধের কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব ভালো বা খুব মধুর রাখতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশ যেন বৈরিতার পথে না যায়। অনেক সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রত্যেক দেশে রাজনীতিবিদরা এই বিষয়টিকে উসকে দেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভারত বিরোধী মানসিক চেতনাও এখন খুব প্রবল। বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি, রাজনীতিবিদেরা ঠিক নির্ধারণ করতে পারছেন না, কে কার প্রতিপক্ষ। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা যেকোনো বিষয়ে সুযোগ পেলেই রাজনীতি করবেন এ আর নতুন কী? এ ব্যাপারে বাংলাদেশি ও ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যে মিল দেখা যায়। সবাই একে অপরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের প্রতিপক্ষ নির্ধারণ ও প্রতিনির্ধারণ করছেন।
সীমান্তবর্তী দুটি দেশের আভ্যন্তরীন সমস্যার কারণে হয়তো নানাভাবে সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে সমগ্র বিশ্বে যে প্রভাব পড়বে তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। কারণ বাংলাদেশের সাথে অনেক অঞ্চলে রয়েছে ভারতের সীমান্ত। যুদ্ধকালীন সময়ে সীমান্ত সমূহ রেড এলার্ট জারী এবং বন্ধ থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান এই তিনটি দেশের সাথে রয়েছে বিভিন্ন আমদানী রপ্তানী বাণিজ্য। যেহেতু এই তিনটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে তাই বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সংকট তৈরী করতে পারে। এমনি অবস্থায় আমদানী রপ্তানী বন্ধ থাকার সম্ভাবনা থাকে প্রবল এবং ফলশ্রুতিতে বাজারে সৃষ্টি হতে পারে সংকট। তার উপর অতিসম্প্রতি রাজনৈতিক পট ও সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে যার কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিচালনা করতে পারছে না অনেক সময় তারাও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যেমন অবনতি হয়েছে তেমনি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে এটিও এই যুদ্ধের কারণে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রভাব ও নানা সংকটের কারণে সম্পর্কের আরো অবনতি হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ব্যক্তিগত অহংবোধের কোনো স্থান নেই, নিজ দেশের স্বার্থ ও মঙ্গলই হবে প্রধান লক্ষ্য। তাই এই মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে বাস্তববাদী ও কৌশলী। এমনিতর পরিস্থিতিতে পাক–ভারত যুদ্ধ এবং মায়ানমারে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশও সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। ভারত–পাকিস্তান উভয়ে পারমানবিক ক্ষমতার অধিকারী তাই এই যুদ্ধে তারা যদি এটি ব্যবহার করে তাহলে বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশে মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা সংকট ঘনিভূত হওয়ার আগেই যেন এই যুদ্ধের ধামামা বন্ধ হয়, নিরাপদে থাকুক সকল দেশের সাধারণ জনগণ, যুদ্ধ মুক্ত হোক এই পৃথিবী।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।