সীতাকুণ্ড উপকূলে জেটি নির্মাণ ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৩ মে, ২০২৫ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে যে কয়টি শিল্পাঞ্চলগুলো তৈরি হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চল অন্যতম। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ২৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় রয়েছে দুই শতাধিক শিল্পকারখানা। যার মধ্যে ভারী শিল্প রয়েছে অন্তত ১৫০টি। সেই হিসাবে এই উপজেলার প্রতি দুই বর্গকিলোমিটারে একটি করে ভারী শিল্পের কারখানা গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, ইস্পাত, কনটেইনার ডিপো, গাড়ি সংযোজন, কাচসহ ভারী শিল্পের বহু কারখানা। বাঁপাশে সাগর উপকূলে তাকালে দেখা যায় পুরোনো জাহাজের ফানেল বা চিমনি। এখানেই গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্প। এলপি গ্যাসের একাধিক কারখানাও রয়েছে এই এলাকায়। এত শিল্প এক উপজেলায়, যেন এটি ভারী শিল্পের রাজধানী। প্রশ্ন হলো সীতাকুণ্ড এলাকায় এতো ভারী শিল্প গড়ে উঠলো কেন? একাধিক শিল্পউদ্যোক্তা জানান, এর প্রধান কারণ হলো এলাকাটি চট্টগ্রাম বন্দরের খুব কাছে। ফলে সহজেই পণ্য আনানেওয়া করা যায়, রয়েছে প্রশস্ত মহাসড়ক। কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সহজে দ্রুত ঢাকাসহ সারাদেশে পরিবহন করা যায়।

শিল্পনীতি ২০২২ অনুযায়ী, ভারী শিল্প বলতে এমন শিল্পপণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে বৃহৎ আকারের উদ্যোগ, বড় যন্ত্রপাতি, ভূমির বৃহৎ এলাকা, উচ্চ খরচ ইত্যাদি বিষয় জড়িত থাকবে। সেই হিসেবে জাহাজভাঙা, রড, ঢেউটিন ও ইস্পাত কারখানা, কাচ, সিমেন্ট, এলপিজি, পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোটরগাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি কারখানা ভারী শিল্পের আওতায় রয়েছে। সীতাকুণ্ডের স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা যায়, সীতাকুণ্ডের দুই শতাধিক কারখানার অধিকাংশই ভারী শিল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাহাজভাঙা শিল্প ৭৫টি, রডঢেউটিনের ৪৩টি, এলপিজি ৯টি, বস্ত্রকল ৫টি, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন ৪টি, সিমেন্ট ৩টি, গাড়ি সংযোজন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা ৩টি, গ্লাসের কারখানা ১ টি ও টাইলসের কারখানা একটি। অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস উৎপাদনের ১০টি, পোলট্রি খাতের ১১টি ও ভোগ্যপণ্যের ৬টি কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে আমদানিরপ্তানি খাতে বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার লেনদেন করে, এমন শিল্প গ্রুপের সংখ্যা আট। এর মধ্যে সীতাকুণ্ডে কারখানা রয়েছে বিলিয়ন ডলার ক্লাবের তিন শিল্প গ্রুপের। এগুলো হলো আবুল খায়ের গ্রুপ, বিএসআরএম গ্রুপ এবং টি কে গ্রুপ।

সীতাকুণ্ডের উল্লেখযোগ্য শিল্পকারখানার মধ্যে রয়েছে ইস্পাত খাতের পিএইচপি স্টিল কমপ্লেক্স, জিপিএইচ স্টিল মিলস, আবুল খায়ের স্টিল মিলস, আবুল খায়ের স্টিল মেল্ট্রিং মিলস, কেএসআরএম, বিএসআরএম স্টিল, কে আই ওয়াই স্টিল মিলস ইত্যাদি। আর সিমেন্ট কারখানার মধ্যে রয়েছে মোস্তফা হাকিম সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট ও রয়েল সিমেন্ট। এ ছাড়া কাচশিল্পের মধ্যে পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরি, টাইলসে বিল্ড কম, অটোমোবাইলে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ ও আফতাব অটোমোবাইল, পাটকলের যন্ত্রাংশ উৎপাদনে গালফ্রা হাবিব, এলপি গ্যাস ও সিলিন্ডার খাতে টোটাল গ্যাস বাংলাদেশ, ওমেরা গ্যাস কোম্পানি, বিএমএলপি গ্যাস, ইউরো পেট্রো প্রোডাক্টস, ইউনিগ্যাস সিলিন্ডার, জেএমআই গ্যাস, পদ্মা গ্যাস,বসুন্ধরা গ্যাস এবং ইউনিভার্সেলের কারখানা রয়েছে। বস্ত্র খাতের কারখানার মধ্যে রয়েছে স্যানম্যান টেক্সটাইল, ডং বিং টেক্সটাইল, ইউনিটেক্স স্পিনিং, ইনফেনিয়া স্পিনিং, বেঙ্গল সিনথেটিক, ডিজিটাল অ্যাকসেসরিস ইত্যাদি।

এই উপজেলায় জাহাজভাঙা শিল্পের মধ্যে রয়েছে এইচ এম শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি,পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ,এস এন করপোরেশন, কবির শিপ রিসাইক্লিং, কে আর শিপ রিসাইক্লিং, তাহের শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং, এনবি স্টিল, যমুনা শিপ ব্রেকার্স, ফোর স্টার শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ, এস এইচ এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি।

ইস্পাত খাতের চারটি বৃহৎ কোম্পানির কারখানা রয়েছে সীতাকুণ্ডে। সেগুলো হলো বিএসআরএম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ ও কেএসআরএম গ্রুপ। এর বাইরে রয়েছে রড উৎপাদনের ৩৩টি সনাতন ও আধা স্বয়ংক্রিয় কারখানা। সব মিলিয়ে সীতাকুণ্ডের কারখানাগুলোর মোট রড উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ৬০ লাখ টন। তবে কাঁচামাল আমদানি ও কোম্পানি গুলোর প্রাথমিক হিসাবে, গত বছর অন্তত ৩৩ লাখ টন রড উৎপাদন হয়েছে এসব কারখানায়, যা দেশের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি। রড ছাড়া সারা দেশের ঢেউটিনের কাঁচামাল ইস্পাতের পাত এবং ঢেউটিনের বড় অংশ আসে সীতাকুণ্ড থেকে। ঢেউটিনসহ ইস্পাতের আসবাব ও গৃহস্থালি পণ্য তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল পরিশোধিত ইস্পাতের পাত তৈরির ছয়টি কোম্পানির মধ্যে চারটিই সীতাকুণ্ডে। এগুলো হলো আবুল খায়ের, পিএইচপি, কেডিএস ও টি কে গ্রুপ। সব মিলিয়ে ঢেউটিন তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল ইস্পাত পাত তৈরির ৭০ শতাংশ সীতাকুণ্ডে উৎপাদিত হচ্ছে। ঢেউটিনেও রয়েছে সীতাকুণ্ডের সিংহভাগ বাজার হিস্যা।

এতো শিল্প থাকার পরেও সীতাকুণ্ডে ভারী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক সুযোগসুবিধা নেই। আর তা নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছে অসন্তুষ্টি। যেমন বন্দর থেকে খুব সহজে কাঁচামাল আনার সুবিধা থাকলেও উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে সরবরাহে খরচ অনেক বেশি। কারণ ছয় চাকার গাড়িতে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন যায় না। গ্লাস, ইস্পাতের মতো ভারী শিল্পে প্রচুর মিঠাপানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সীতাকুণ্ডের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের বিপুল অর্থ খরচ করে পানির বিকল্প ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। আরো রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপের চাঁদাবাজি।

কয়েকদিন আগে দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেলো। এর একমাত্র লক্ষ্য হলো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোথাও বিনিয়োগের আগে দেশীয় শিল্পের মালিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। তারা দেখে এদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন, নীতি সহায়তা ও বাধা কী কীইত্যাদি। আসলে শিল্পোদ্যোক্তারা চায় বিনিয়োগের সুষ্ঠু ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ। তারা চায় সহজ নীতি সহায়তা ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস। তাই স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের সব ধরনের সমস্যা আগে সমাধান করতে হবে, লজিস্টিক সার্পোট দিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এইসব দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন। বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। আর দশজন অসৎ ব্যবসায়ীর মত টাকা পাচার না করে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে বিনিয়োগ করেছেন। তাই তাদের সমস্যাগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করতে হবে। যেন তারা আরো বেশি বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে পারে। তাই সীতাকুণ্ডের বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজনে উপকূলে চারপাঁচটি জেটি নির্মাণ করা যেতে পারে। যাতে বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে কম সময় ও খরচে কাঁচামাল কারখানায় আনতে পারে এবং একইভাবে ঐ জেটিগুলো দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কম খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারে। এতে করে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীমান্তবর্তী দেশ ভারত-পাকিস্তান-মিয়ানমার সংকটে সমস্যার আবর্তে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধমাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আঁরার ইউনূস : আইয়ুন জে