সিলেট-সুনামগঞ্জ বিচ্ছিন্ন

‘১২২ বছরের ইতিহাসে’ ভয়াবহ বন্যা ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি, আরও ১৭ জেলা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে নদ-নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। সিলেট-সুনামগঞ্জের পর হাওরের আরেক জেলা নেত্রকোণাও ডুবছে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে জেলার আরও তিনটি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

ঢাকার সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেটে রানওয়ের কাছাকাছি পানি চলে আসায় এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্যার পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন আপাতত বন্ধ থাকবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে এখন সরাসরি সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবে না।

প্রায় বিচ্ছিন্ন সিলেট। সিলেটের অন্যতম বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র কুমারগাঁও স্টেশনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে গেছে সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। সুনামগঞ্জে গত দুদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এদিকে ৬ ঘণ্টা পর সিলেট নগরীর কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্ন সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ কিছু এলাকায় দুর্যোগকালীন জরুরি টেলিযোগাযোগ সেবা স্থাপনে কাজ করছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। খবর বাসস, বিডিনিউজ, বাংলানিউজ ও বিবিসি বাংলার।

মে মাসের শেষ দিকে একবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল সিলেট। এ নিয়ে এই অঞ্চলে এ বছর তিন দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। এদিকে আগামী দুদিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছেন শিশু ও বয়স্করা। আটকেপড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানে শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ।

সিলেটের সবক’টি উপজেলা ও অর্ধেক শহর, সুনামগঞ্জের উপজেলা ও পৌর শহর বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ও সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক। দুই জেলায় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে বন্যা চলছে তা ১২২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি বলেছেন, দেশের ১০ জেলার ৬৪ উপজেলা বন্যার কবলে পড়েছে। সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে, উদ্ধার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম চালাবে তারা।

সিলেটের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার দিনগত রাতে সিলেটে বৃষ্টি কিছুটা কম ছিল। এতে পানি এক-দুই ইঞ্চি কমেছে সকাল ৯টা পর্যন্ত। এরপর থেকে সিলেটে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা বন্যা পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি।

বন্যার পাশাপাশি নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানির নিচে রয়েছে সবগুলো রাস্তাঘাট। বন্যায় নদনদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। সিলেটে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

এদিকে, সিলেটে বন্যা দুর্গত এলাকায় পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী তৎপর রয়েছে। শুক্রবার বিকেল থেকে সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন, ৬টি মেডিকেল টিম। গতকাল সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উদ্ধার কাজে নৌবাহিনী সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিকেলের মধ্যে ৬০ জনের আরেকটি দল আরও ক্রুজ ও হেলিকপ্টারসহ উদ্ধার কাজে যুক্ত হবে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতে সিলেট এসে পৌঁছায়। গতকাল সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের ১টি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে একটি টিম সকাল থেকে কাজ শুরু করে। আরেকটি টিম কোম্পানিগঞ্জে কাজ শুরু করেছে।

সিলেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ শাখা জানিয়েছে, ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৭ হাজার ৯০০ বস্তা শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও ৮ হাজার প্যাকেট খাবার ও ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব এলাকায় আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

আরও ১৭ জেলা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা : মেঘালয় ও আসামে ক্রমাগত বৃষ্টি হওয়ায় তা বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এর মধ্যেই সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, আগামী দুদিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় তা কুড়িগ্রাম, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে প্রবেশে করে আরও এগিয়ে আসছে। ফলে জামালপুর, বগুড়া, শেরপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারি ও পাবনায় বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে আরও ৫৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। গত তিন দিনে এখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি দ্রুত গতিতে সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে নেমে এসেছে। সেজন্য বন্যা অল্প সময়ে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

সিলেট-সুনামগঞ্জে আরও অবনতি হবে : সিলেট ও সুনামগঞ্জে আগামী দুদিনে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। তিনি জানান, মঙ্গলবার ও বুধবার থেকে পানি কমে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি আরও উন্নতি হবে। তবে, দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা দেখা দেবে। এই সময়ে ওপরের পানি নেমে যাবে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে তিনি এ কথা জানান।

আখাউড়া বন্দরে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত : টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থল বন্দরে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরের পাশে সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গতকাল আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তিনি বলেন, শুধু মাছ ও গ্যাসের পাঁচটি চালান আগরতলা বন্দরে প্রবেশ করেছে। পণ্যবোঝাই অন্তত ২০টি ট্রাক আটকা পড়ে আছে।

সড়কগুলো যেন নদী : বন্যার পানিতে সিলেট নগরের প্রত্যেকটি সড়ক এখন নদীতে পরিণত হয়েছে। নিজ আশ্রয় ছেড়ে লোকজন নিরাপদ কোনো স্থানে যাবেন, সে ব্যবস্থাও নেই। ফলে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।

অতিরিক্ত বাস ভাড়া : সিলেটের মানুষ এখন মোকাবিলা করছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। সংকটাপন্ন এ অবস্থায়ও অভিযোগ উঠেছে হবিগঞ্জ-সিলেট রুটে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগামাধ্যম ফেসবুকে খবর ভাসছে, সিলেটের বন্যার ভয়াবহতার মধ্যে একদল মুনাফাখোর, নৌকার ২০০ টাকার ভাড়া ২০ হাজারে, ৫০০ টাকার ভাড়া ৫০ হাজারে উঠিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিনভর বন্যা নিয়ে সতর্ক করে নিজেই মারা গেলেন তিনি
পরবর্তী নিবন্ধতুমিই তো আমার বাবা