সিরিয়াল প্রথা চালু হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না লাইটারেজ জাহাজ চলাচল

অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহন ধুয়ে ফেলার বাধ্যবাধকতা থাকায় ভোগপণ্য খালাসে যাচ্ছে না বরাদ্দ দেয়া অনেক জাহাজ ও আমদানি বানিজ্য নেতিবাচক প্রভাক

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে সিরিয়াল প্রথা প্রবর্তন করা হলেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সিরিয়ালবিহীন জাহাজ চলাচল। আবার বরাদ্দ নেয়া জাহাজও কাজে না যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এতে বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদার ভ্যাসেল অলস বসে থাকার পাশাপাশি শ্রমিকদেরকেও বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতার যোগান দিতে হচ্ছে। যা দেশের আমদানি বাণিজ্যের জন্য ক্রমে হুমকি হয়ে উঠছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

অপরদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ করা হয়েছে। বিডব্লিউটিসিসির সাথে কার্গো এজেন্টদের কোন চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী জাহাজ চলাচল ও পণ্য পরিবহন হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে পরিবহন করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য, কয়লা, পাথর, ক্লিংকারসহ আমদানিকৃত এসব পণ্যবাহী বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বার্থিং নিতে পারে না সেগুলো বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজে খালাস করে দেশের অন্তত ৫৭টি ঘাটে পাঠানো হয়ে থাকে। বন্দরের বহির্নোঙর থেকে দেশের নানা স্থানে পণ্য পরিবহনে বেসরকারি মালিকানাধীন প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব লাইটারেজ জাহাজের উপরই দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুট পুরোপুরি নির্ভরশীল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি দীর্ঘদিন ধরে দেশের লাইটারেজ জাহাজ সেক্টর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। ডব্লিউটিসি’র প্রবর্তিত সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে আমদানিকারকেরা জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করতেন। জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকাল এজেন্ট এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টে ডব্লিউটিসিতে দায়িত্ব পালন করতেন। কোন কোন লোকাল এজেন্ট আবার পণ্যের এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, জাহাজ বরাদ্দ না দেয়া, ডেমারেজ এবং ডেসপাসের টাকা পয়সার নয় ছয়, বরাদ্দ দেয়া হলেও জাহাজ না পাওয়াসহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে ডব্লিউটিসির কার্যক্রম নিয়ে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন জাহাজ মালিকেরা। মাস কয়েক আগে জাহাজ মালিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিপুল অংকের টাকা আটকে থাকাসহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মুখে ভেঙে যায় ডব্লিউটিসি।

জাহাজ মালিকদের বিরোধ যখন তুঙ্গে তখন গত ১৫ অক্টোবর সরকার ‘নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা২০২৪’ শীর্ষক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকে ডব্লিউটিসির আদলেই গঠন করা হয় বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নামের নয়া প্লাটফরম। বিডব্লিউটিসিসি পণ্যের এজেন্ট এবং লোকাল এজেন্টদের মাধ্যমে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ, মোতায়নসহ জাহাজ মালিক এবং আমদানীকারকদের সাথে সমন্বয় করে সংস্থাটি পরিচালনা করার দায়িত্ব নেয়। শুরুতে জাহাজ মালিকদের অনেকেই এর বিরোধীতা করলেও সরকারের প্রজ্ঞাপনের কারণে একে একে প্রায় সকলকেই সিরিয়াল প্রথায় বিডব্লিউটিসিসির নিয়ন্ত্রণে আসতে হয়। অবশ্য মামলা করে বেশ কিছু লাইটারেজ জাহাজ এই সংস্থার সিরিয়ালের বাইরে চলাচল করে।

গতকাল একাধিক আমদানিকারক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিডব্লিউটিসি লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সিরিয়ালের বাইরে প্রচুর জাহাজ চলাচল করে। কিছু কিছু শ্রমিক নেতাও সিরিয়ালবিহীন জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরণের নিয়ামক হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, আমরা আইন মেনে দিনের পর দিন জাহাজের জন্য অপেক্ষা করি, অপরদিকে যারা আইন মানে না তারা যখন তখন জাহাজ পেয়ে যাচ্ছে।

আমদানিকারকেরা বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে বরাদ্দ দেয়া জাহাজ পণ্য খালাসের জন্য না যাওয়া। একটি বিদেশি মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক লাগে, পাহারাদার লাগে। জাহাজ বরাদ্দ পাওয়ার পর শ্রমিকের গ্যাং বুকিং দেয়া হয়। শ্রমিকদের তদারক করার জন্যও লোক দিতে হয়। গ্রেভ ভাড়া করতে হয়। অথচ জাহাজটি যখন আগাম কিছু না জানিয়ে পণ্য খালাস করতে যায় না, তখন সবকিছু মারা পড়ে। সকলকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতার যোগান দিতে হয়। আবার জাহাজটি যে কাজে যাবে না সেটিও আগে জানায় না। পরবর্তীতে বিডব্লিউটিসিসির কাছে রিপ্লেসমেন্ট জাহাজ চেয়েও সময়মতো পাওয়া যায় না। গত কিছুদিন ধরে এই প্রবণতা আশঙ্কাজন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে বলে মন্তব্য করে তারা বলেন, বিশেষ করে ভোগ্য পণ্য নিয়ে সংকট হচ্ছে। এই ধরণের পণ্য পরিবহনের আগে জাহাজের হ্যাজ ধুয়ে মুছে ফেলার একটি বাধ্যবাধকতা থাকায় গমসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য সিরিয়ালে পড়লে নানা অজুহাতে সেখানে কাজে যায় না লাইটারেজ জাহাজগুলো। ফলে ভোগ্য পণ্য আমদানিকারকদের সংকটে পড়তে হচ্ছে।

একজন জাহাজ মালিক গতকাল জানান, যে প্রত্যাশা নিয়ে বিডব্লিউটিসিসি গঠন করা হয়েছিল তা পূরণ হচ্ছে না। নানা ধরণের অনিয়ম হচ্ছে। আমরা সরকারের নিকট সবকিছুর সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি ভোগ্য পণ্য পরিবহনে জাহাজ মালিকদের কিছুটা অনীহা থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, কিছু কিছু জাহাজ ভোগ্য পণ্য পরিবহন করতে চায় না।

চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, বিডব্লিউটিসিসি এর সাথে অন্যের এজেন্টের মধ্যে অদ্যাবধি কোন চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ার কারণে কিছু কিছু পণ্যের এজেন্ট এর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাপারে পণ্যের এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি চিঠি প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বলতে চাই বিডব্লিউটিসিসি যদি সুষ্ঠুভাবে চলমান থাকে তাহলে এই সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক হবে। ডেসপ্যাচডেম্যারেজের হার নির্ধারণ এবং অন্যান্য বিষয় নিষ্পত্তি করে অতিশীঘ্রই চুক্তি হওয়াটা আবশ্যক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। পারভেজ আহমেদ বলেন, বিডব্লিউটিসিসির নেতৃবৃন্দের সচেতন হওয়া দরকার যাতে এই পরিস্থিতিতে কেউ এই সেক্টরের ক্ষতি করতে না পারে।

বিষয়টি নিয়ে বিডব্লিউটিসিসির কনভেনর সাঈদ আহমেদ বলেন, আমরা নতুনভাবে সবকিছু গুছিয়ে আনছি। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিশৃংখলা থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে অচিরেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি সিরিয়ালের বাইরে কিছু জাহাজ চলাচল করছে বলে স্বীকার করে বলেন, আমরা কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে এসব অনিয়ম রোধ করবো। তিনি কিছুটা সময়ের দরকার বলে মন্তব্য করে বলেন, এই সেক্টরের স্বার্থে আরো অনেককিছু করতে হবে। আমরা কিছু পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। আদালতের বিষয়টি মিটে গেলে আমাদের কাজে আরো গতি আসবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় সার কারখানায় আগুন, উৎপাদন বন্ধ ৩ ঘণ্টা
পরবর্তী নিবন্ধথার্টি ফার্স্ট নাইটে সিএমপির ১৩ নির্দেশনা