সিয়েরা লিওনকে বলা হয় হিরের খনিতে পরিপূর্ণ পশ্চিম আফ্রিকার একমাত্র গরীব দেশ। দেশটির মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে চকচকে হিরে। আর এ হিরে নিয়েই পশ্চিমাদের যতো লোলুপ দৃষ্টি। এ হিরে নিয়েই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলেছে বছরের পর বছর। ১৯৯১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত দেশটিতে গৃহযুদ্ধে মারা গেছে ৫০ হাজাররেও অধিক মানুষ। ২০০২ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান হলেও এখনও পশ্চিমা দেশগুলো দেশটিতে ঘাবটি মেরে বসে আছে। দেশটিতে ব্যাপক হিরে থাকার পরও ৭০ ভাগ মানুষ এখনও গরীব। সিয়েরা লিওনের প্রতি ঘরে ঘরে সন্তানরা একটু বড় হলেই হিরে খোঁজার কাজে নেমে পড়ে আর এ কাজে মদত দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। এ হিরেগুলো তারা তাদের কাছ থেকে কিনে নেয় পানির দামে। ১৯৬১ সালে ২৭ এপ্রিল স্বাধীনতা লাভ করার পর সিয়েরা লিওন ওই বছরেই জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। তার তিন দশক পরেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সে গৃহযুদ্ধ চলে এক দশক জুড়ে।
এ গৃহযুদ্ধ থামানোর জন্য জাতিসংঘ নিয়োগ করে বিভিন্ন দেশের চৌকস সেনাবাহিনী আর এ জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিয়েরা লিওনকে পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। ওষুধ, খাদ্য, বাড়ি নির্মাণ, গভীর অরণ্য সিয়েরা লিওনবাসীদের সাহায্য সহযোগিতা করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যা তৎকালীন সময়ে বিশ্ববাসীরও নজরে পড়ে। সিয়েরা লিওনবাসীরাও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন সহযোগিতা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। সিয়েরা লিওনকে পুনর্গঠন করতে গিয়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইংরেজি ভাষার সাথে সাথে সিয়েরা লিওনবাসীদের সাথে বাংলা ভাষায়ও কথা বলতে শুরু করে। আর বাংলাভাষাকে সিয়েরা লিওনবাসী খুব সহজে গ্রহণ করতে থাকে এবং কিছুক্ষেত্রে তারা এ ভাষায় কথাও বলতে শিখে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে সিয়েরা লিওনবাসী এক সময় বাংলা ভাষার ভক্ত হয়ে যায় এবং এ ভাষায় তারা ভাবের আদান প্রদানসহ বিভিন্ন কাজ করতে থাকে। এমনকী অসংখ্য সিয়েরা লিওনবাসী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পর্যন্ত একেবারে বিশুদ্ধ বাংলায় মুখস্থ করে তা গাইতে থাকে। মিডিয়ায় আফ্রিকান মানুষদের অনর্গল বাংলা ভাষায় কথা বলতে দেখে প্রথম প্রথম অনেকই অবাক হলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের এমন অসাধ্য সাধনকে বিশ্ববাসী সাধুবাদ জানাতে থাকে সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রশংসায় ভাসে পুরো বিশ্ব।
গৃহযুদ্ধের পর সিয়েরা লিওন পুনর্গঠনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ব্যাপক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলহাজি আহমদ তেজান কাববাহ বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকেই সিয়েরা লিওনবাসীরা ক্রমেই বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এখন সেখানে বাংলা ভাষার স্কুল গড়ে ওঠেছে যেখানে ছোট ছোট শিশুরা বাংলা ভাষা চর্চা করছে। প্রকৃতপক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন যেখানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে সেখানে সিয়েরা লিওনের মতো একটি ভিন্ন ভৌগলিক এবং ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষজন বাংলা ভাষায় কথা বলছে এটি বাংলাদেশ এবং আমাদের জন্য পরম গর্বের। প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের মাতৃভাষা অন্য একটি দেশের বেশিরভাগ মানুষ বলতে পারাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। দেশটির মানুষের মধ্যে উক্ত ভাষা শেখার জন্য প্রাণের তাড়না না থাকলে তা কখনও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সিয়েরা লিওনবাসীরা আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন এবং এ ভাষা দ্রুত শেখারও তাগিদ অনুভব করেছেন তাই তারা এ ভাষাকে সহজেই আত্মস্থ করতে পেরেছেন।
এর আগেও ব্রিটিশ আমলে আমরা লক্ষ্য করেছি অনেক ব্রিটিশই বাংলা ভাষায় আদো আদো গলায় কথা বলতে পারতেন তবে তারা এটা বাংলাভাষাকে ভালোবেসে শেখেনি। এ ভাষা তারা শিখেছিলেন এদেশে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য। এক্ষেত্রে সিয়েরা লিওন সম্পূর্ণ আলাদা। তারা বাংলা ভাষাকে শুধু শেখেনি তার সাথে সাথে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে কাগজে কলমে স্বীকৃতিও দিয়েছেন। এবং হৃদয়ে ধারণও করেছে। এটি সিয়েরা লিওনবাসীর আরেকটা দেশের ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার নিদর্শন। আমরা সিয়েরা লিওনের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে চাই। আর সেজন্য চাই একদল ভাষা বিজ্ঞানীর যথাযথ গবেষণা।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।