সিনোফার্মের টিকা সম্পর্কে জানার আছে যা যা

দেশে ব্যবহারের অনুমোদন

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

রাশিয়ার ‘স্পুৎনিক-ভির’ পর এবার চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিল বাংলাদেশ সরকার। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, সিনোফার্ম যে টিকা উদ্ভাবন করেছে, আমরা আজকে সেটার ইমার্জেন্সি ইউজের অথরাইজেশন দিয়েছি। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকার সরবরাহ সঙ্কটে টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে জটিলতার মধ্যে দেশে দ্রুত দুটি নতুন টিকার অনুমোদন দেওয়া হল। গত ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকার অনুমোদন দেওয়ার পর গত বুধবার মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুৎনিক-ভি টিকাও বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসনের সবুজ সংকেত পায়। সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার আনুষ্ঠানিক নাম বিবিআইবিপি-সিওরভি। এ টিকাও ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ করে নিতে হয়। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এ টিকা ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকরিতা দেখিয়েছে বলে উৎপাদনকারীদের ভাষ্য। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এই টিকা কেনা হবে সরকারি পর্যায়ে। চীন উপহার হিসেবে ৫ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। এগুলো আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে। মাহবুবুর রহমান বলেন, এই টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল হয়েছে চীনে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বিশ্বের পাঁচটি দেশের ৫৫ হাজার মানুষের ওপর হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি কমিটি এ টিকার সব নথিপত্র যাচাই করেছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমাদের যে কমিটি আছে, সেই কমিটি এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা আজ চীনের সিনোফার্মের এই টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছি। তিনি বলেন, টিকা বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে ১ হাজার মানুষের ওপর প্রয়োগ করে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। আমরা দেখব এই টিকার সেইফটি এবং অ্যাফিকেসি কেমন। এরপর গণটিকাদান কার্যক্রমে সিনোফার্মের টিকা ব্যবহার করা হবে। খবর বিডিনিউজের।
যারা প্রথম ডোজে অঙফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, তারা দ্বিতীয় ডোজে সিনোফার্মের টিকা নিতে পারবেন কি না জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মাহবুব বলেন, দ্বিতীয় ডোজে তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই নেবেন। অন্য কোনো টিকা দিয়ে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে আমাদের ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ আছেন, তাদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। উনারা একটা মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
কেবল আমদানি নয়, স্পুৎনিক-ভি ও সিনোফার্মের টিকা দেশেই উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে অথবা কাঁচামাল নিয়ে এসে বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিতে টিকা উৎপাদন করা যাবে। বাংলাদেশের ইনসেপ্টা, পপুলার এবং হেলথকেয়ার ফার্মার টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। তবে প্রাথমিকভাবে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে কথা হচ্ছে বলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান।
তিনি বলেন, উনারা (চীনের প্রতিনিধি) আসবেন। তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালসই দেখবেন, সক্ষমতা অ্যাসেস করবেন। করার পরে সেই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতা হবে।
সিনোফার্মের টিকা সম্পর্কে যা যা জানার আছে : অনুমোদন দেয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ বা সিনোফার্মের্র উৎপাদিত কোভিড টিকা আমদানির পথ উন্মুক্ত হলো। চীনের বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টসের উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-কোরভি নামের এই দুই ডোজের টিকা জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া যাবে কিনা আগামী সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। চীন এরই মধ্যে এই টিকার কোটি ডোজের বেশি মজুদ গড়ে তুলেছে এবং নিজ দেশে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশে রপ্তানিও করছে। কোনো টিকার জরুরি ব্যবহারের জন্য ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়া ওই টিকার নিরাপত্তা ও সক্রিয়তার একটি সূচক হিসেবে গণ্য হয়। বিভিন্ন দেশের জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্যও তখন ওই টিকার অনুমোদন দেওয়া সহজ হয়ে যায়। ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পেলে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করার জোট কোভ্যাঙের তালিকাভুক্ত হবে সিনোফার্মের এই টিকা। সেক্ষেত্রে চীনের এই টিকাই হবে পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত প্রথম বৈশ্বিকভাবে অনুমোদিত টিকা। ফাইজার-বায়োএনটেক, অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা জরুরি ব্যবহারে ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পেয়েছে। এ সপ্তাহে মডার্নার টিকাও অনুমোদনের জন্য পর্যালোচনা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিনোফার্মের কোভিড-১৯ টিকার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে এর উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের অধীন বেজিং বায়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের টিকা মানবদেহে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকর বলে অন্তর্বর্তী তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গেছে। চীন, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফলাফলের ভিত্তিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত জানিয়েছে, এই টিকা ৮৬ শতাংশ কার্যকর।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে সিনোফার্মের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দুই ধরনের ফলাফল পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত ফলাফল পরে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন। তবে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই একটি জরুরি টিকাদান কর্মসূচির অধীনে চীনের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়। ডিসেম্বরে পেরুতে এক স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জেরে এই টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহার স্থগিত করা হলেও পরে সেই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়।
টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের স্থগিতাদেশ অস্বাভাবিক নয়, যুক্তরাজ্যেও অঙফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহার স্থগিত করা হয়েছিলো গত সেপ্টেম্বরে যা পরে তুলে নেওয়া হয়। ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশগ্রহণকারীদের রক্তের নমুনার ওপর পরীক্ষাগারের পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের সূত্র ধরে সিএনবিজির ভাইস প্রেসিডেন্ট ঝ্যাং ইউনতাও বলেন, সিনোফার্ম উৎপাদিত কোভিড-১৯ প্রতিরোধী দুটো টিকাই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে এবং ব্রিটেন ও সাউথ আফ্রিকার করোনাভাইরাসের ধরন এবং আরও কয়েকটি ধরনকে বেশ ভালোভাবে কাবু করতে পেরেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই টিকা গ্রহণকারীদের কয়েকজনের দেহে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়ায় তৃতীয় ডোজ প্রয়োগ করতে হয়। তবে টিকাগ্রহণকারীদের মোট সংখ্যার তুলনায় এদের সংখ্যা নগণ্য। সিনোফার্ম জানিয়েছে, চীনের বাইরের দেশগুলোতে তৃতীয় পর্যায়ের ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের’ ফলাফল পর্যালোচনার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে দুই ডোজের এই টিকার জন্য আরেকটি ফলোআপ বুস্টার ডোজ দরকার হবে কিনা।
১৩০ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে টিকা তৈরির পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ করে এই টিকার উদ্ভাবনে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করেছে সিনোফার্ম। ভাইরাসটি যাতে নিজের জিনের প্রতিরূপ তৈরি করতে না পারে সেজন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক ব্যবহার করেছে। তারপরও নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, সিনোফার্মের টিকার কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। এ টিকার উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বড় সংখ্যায় সক্রিয় করোনাভাইরাসের নমুনা দরকার হয়, যা জৈবনিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
সক্রিয় নমুনাগুলো নিষ্ক্রিয় করে ফেলার পর অতিরিক্ত উৎপাদন ধাপ যুক্ত করতে হয়, যেখানে টিকার উৎপাদন প্রক্রিয়া শেষে কোনো ভাইরাস সক্রিয় না থাকারন বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়। রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেব্রুয়ারিতে সেনেগাল সিনোফার্মের দুই লাখ ডোজ টিকার জন্য ৩৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের কিছু বেশি পরিশোধ করেছে, সেক্ষেত্রে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়েছে প্রায় ১৯ ডলার। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, গত মাসে হাঙ্গেরি সিনোফার্মের প্রতিডোজ টিকার জন্য ৩৬ ডলার দিতে রাজি হয়েছে, যা এই একে বিশ্বের সবচেয়ে দামি টিকার অবস্থানে নিয়ে গেছে। চীনে যারা এই টিকা নিয়েছেন তাদের উদ্ধৃত করে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই ডোজের জন্য তাদের ৬০ থেকে ১৫০ ডলারের মতো দিতে হয়েছে। সিনোফার্ম জানিয়েছে, দুই ডোজের এই টিকার দাম ১৫০ ডলারের নিচেই থাকা উচিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে জ্বালানি বোঝাই জাহাজে বিস্ফোরণ, নিহত ২
পরবর্তী নিবন্ধকরোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ অন্য কেন্দ্রেও নেওয়া যাবে