আইনি বাহিনীর বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে দেড় বছর আগে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার যে ঘটনা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, সেই মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা এবং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্য এবং পুলিশের তিন সোর্সকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মামলার ১৫ আসামির মধ্যে বাকি চার পুলিশ সদস্য এবং তিন এপিবিএন সদস্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। কঙবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সোমবার বিকালে জনাকীর্ণ আদালতে এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন। ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করা হয় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে। আর তাতে আট আসামির সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী যে নিজেদের অপরাধ ঢাকতেই ‘অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যা করেছিলেন, রায়ে সে বিষয়টি উঠে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম। রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত রায়ে অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। সেই ষড়যন্ত্র হয়েছে, যে অপরাধগুলো আসামিরা আগে করেছেন, তা ঢাকা দিতে। তারা মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ- এসব তথ্য পেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর তিনি এসব বিষয়ে ভিডিও ধারণ করেন। তখন তাকে হুমকি দেওয়া হয় কঙবাজার ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তিনি এলাকা ছেড়ে যাননি। সে কারণে পরিকল্পনা করে অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে লিয়াকতের সাথে মিলে এপিবিএন চেকপোস্টে প্রথমে মেজর সিনহাকে গুলি করে আহত করে। প্রদীপ কুমার দাশ আহত সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে ও লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্র, সাক্ষ্য, আসামিদের সাক্ষ্য ও জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা বারবার এসেছে জানিয়ে পিপি ফরিদুল আলম বলেন, ‘এতেই অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রমাণিত।’
মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি। প্রদীপকে নিয়ে এই ভাষ্য খোদ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, যা বলা হয়েছে সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে। র্যাবের দেওয়া এই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অপরাধ কর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। ২০১৬ সালে কঙবাজারের মহেশখালী থানার এবং তার দুই বছর পর টেকনাফ থানার ওসির দায়িত্বে থাকা প্রদীপের একের পর এক খুন চালিয়ে যাওয়ার তথ্যগুলো সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরই প্রকাশ পায়। কঙবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে থাকাকালেও নানা অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর এবং একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেসব অভিযোগ অতটা বড় হয়ে ওঠেনি ২০২০ সালের ৩১ জুলাইয়ের আগে, যেদিন কঙবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া এলাকায় তল্লাশি চৌকিতে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা।
ব্যাপক আলোচনা ওঠার পর পুলিশ থেকে বরখাস্ত হয়ে ২০২০ সালের ৬ অগাস্ট আদালতের মাধ্যমে প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ অগাস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কঙবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রদীপের আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাব।’ অন্যদিকে, সিনহার বোন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস প্রধান দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় আংশিক প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সেদিনই আমরা সন্তুষ্ট হব, যেদিন সাজা কার্যকর হবে।’ অন্যদিকে খালাস পাওয়া তিনি এপিবিএন সদস্যের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায়ে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। প্রমাণ হয়েছে যে, এই দেশে আইনের শাসন আছে, ন্যায়বিচার আছে। এই ন্যায়বিচারের নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।’
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আলাউদ্দিন এম এ ওয়াদুদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। এই রায় প্রমাণ করল, দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে। যখন রায় যখন কার্যকর হবে তখন পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট হব।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সবাই ধৈর্য নিয়ে কাজ করলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই দেখা গেল মামলার এ রায়ে। সন্দেহ নেই, এটি আবার উচ্চ আদালতে যেতে পারে। সেখানেও এ রায় বহাল থাকবে-সেই প্রত্যাশা সকলের।