সিনহা হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত

নেপথ্যে প্রদীপের ইয়াবা বাণিজ্য ১৫ জনের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযোগপত্র

কক্সবাজার প্রতিনিধি | সোমবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ইয়াবা বাণিজ্যের খবর জেনে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। থানায় বসেই করা হয় হত্যা পরিকল্পনা। র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে এই তথ্য। সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম গতকাল রোববার সকালে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
বিডিনিউজ জানায়, গতকাল বিকালে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই তদন্তের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন এ বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি বলেন, এ মামলার তদন্তের মূল বিষয় হচ্ছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। প্রদীপের স্বেচ্ছাচারিতা ও ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি সিনহা জেনে যাওয়ায় এই ঘটনা।
সিনহা হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে গতকাল আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি ১৪ জন গ্রেপ্তার আছেন।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলামকে। মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৭ আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বাকি ২ জন পুলিশ সদস্য নয় বলে জানায় জেলা পুলিশ। পরে মামলার তদন্তে আসা আরো ৭ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ সদস্য, ৩ জন এপিবিএন সদস্য ও ৩ জন স্থানীয় বাসিন্দা। আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও রুবেল শর্মা ছাড়া বাকি ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।
এছাড়া এই ঘটনার তদন্তে ১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রশাসনিক ওই তদন্তে কঙবাজারে চেকপোস্টে পুলিশের ভূমিকা অপেশাদার ও হটকারী বলে মন্তব্য করা হয়। ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেন তারা।
গতকাল আদালতে দাখিলকৃত মামলার অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার ১৪ আসামি ছাড়াও ‘সাগর’ নামের একজনকে পলাতক আসামি দেখানো হয়। পলাতক আসামি সাগর টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের কিলিং মিশনের সহযোগী বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. খায়রুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সিনহা হত্যা মামলাটি আমরা নানাভাবে তদন্ত করেছি। তদন্তে পাওয়া তথ্যগুলো সাজিয়ে চার্জশিট হিসেবে জমা দিয়েছি। মামলার তদন্তে নেমে র‌্যাব এ ঘটনার সাথে ১৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপসহ ১৪ জন কারান্তরীণ রয়েছে। সাগর নামে ওসি প্রদীপের এক সহযোগী পলাতক রয়েছে।
থানায় বসে পরিকল্পনা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যা পরিকল্পনা করা হয়েছে টেকনাফ থানায় বসে। গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেলস শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য তিনজন সহযোগীসহ কঙবাজারের হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে উঠেন মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা। এই খবর পৌঁছায় টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারের কাছে। তখন থেকেই ওসি প্রদীপ অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের বলেন, ভিডিও পার্টিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, যেকোনো মূল্যে।
এরপর থেকেই সিনহাকে নজরদারিতে রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। ৩১ জুলাই সকালে একটি বাহিনীর বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, সিনহা প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সোর্সের মাধ্যমে সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন। এরপর ওইদিন (৩১ জুলাই) রাত ১০টার দিকে কঙবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কঙবাজারের দিকে আসার পথে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এদিকে সিনহা হত্যা মামলার দায়েরকৃত চার্জশিটকে ‘অবৈধ’ বলে দাবি করেছেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলীর পক্ষে করা রিভিশন আবেদনের আইনজীবী মাহমুদ সালাহ উদ্দীন। গতকাল সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে এই প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি জানান, এই মামলার আসামিদের রিমান্ড ও ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দীও উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে।
ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন : বিডিনিউজ জানায়, ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি জেনে যাওয়ায় সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কঙবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কঙবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে এমনটিই পেয়েছেন।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রশংসা করে তিনি বলেন, পুলিশে ৩২ বছর ধরে কাজের অভিজ্ঞতা ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও প্রভাবমুক্ত হয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। চার মাস দশ দিন ধরে তদন্ত শেষে ২৬ পৃষ্ঠার যে তদন্ত প্রতিবেদন খায়রুল ইসলাম আদালতে দিয়েছেন, তাতে মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ১৫ আসামি হলেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএনের তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।
আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনায়’ ছিলেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দদুলাল, তিন এপিবিএন সদস্য এবং বেসামরিক তিনজন, যাদের পুলিশের মামলায় সাক্ষী করা হয়েছিল। এছাড়া এসআই লিটনসহ অন্যরা ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
তিনি আরো বলেন, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লিয়াকত তিন সোর্স নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজের সঙ্গে হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে সাক্ষাতও করেছিলেন। সে তথ্যও তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন। এছাড়া গুলি করার পর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয় এবং পরে লোক দেখাতে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তবে সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র‌্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা আগেই ধ্বংস করা হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রদীপ সরকারি বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে কঙবাজারে অভয়ারণ্য তৈরি করেছিল। প্রদীপের অপরাধের সঙ্গে তখনকার পুলিশ সুপারের কোনো সংশ্লিষ্টতার তথ্য তদন্তে এসেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপারের ‘উদাসীনতা ও অপেশাদার আচরণের’ প্রমাণ পেয়েছেন। তাই প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিপ্রা ও সিফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালু ইউনেস্কোর