সিএলএফ একদিন শুধু দেশের নয়, বিশ্বের জন্য রোল মডেল হবে

চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশনের পুনর্মিলনীতে খসরু । লায়নিজমের মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে আরো সুন্দর ও মঙ্গলময় করে তুলছি : আজাদী সম্পাদক

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশি জনগণের খরচ সবচেয়ে বেশি। এতদিন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতে এই স্বাস্থ্য খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হয়ে চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশন যেভাবে নিজেদের অর্থায়নে শহর, গ্রাম, দুর্গম পার্বত্য এবং উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও অসচ্ছল চক্ষুরোগীদের সাশ্রয়ী মূল্যে ও বিনামূল্যে মানসম্পন্ন চক্ষু চিকিৎসাসেবা প্রদান করে দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে, এমন ঘটনা বিরল। লায়নদের সমাজসেবামূলক এমন কর্মপ্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। মানবিক মূল্যবোধ থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বলেই এই প্রতিষ্ঠানের সেবা মানুষের কাছে পৌঁছায়। যার ফলে দেশিবিদেশি হিতৈষী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস করেই আপনাদের সেবামূলক কাজে অংশীদার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় জাকির হোসেন রোডে সিএলএফ কমপ্লেঙে চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশনের (সিএলএফ) আজীবন সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সিএলএফ চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন নাসির উদ্দীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি৪ বাংলাদেশের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর লায়ন কোহিনূর কামাল, ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান,ও প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন এম আই খান এবং দৈনিক আজাদী সম্পাদক ও প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন এম এ মালেক। অনুষ্ঠানে আগত লায়ন ও আজীবন সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক।

অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সেকেন্ড ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোহাম্মদ কামরুজ্জামান লিটন এবং প্রাক্তন জেলা গভর্নরবৃন্দের মধ্যে লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, লায়ন ডা. শ্রীপ্রকাশ বিশ্বাস, লায়ন এস এম সামশুদ্দিন, লায়ন মোস্তাক হোসাইন, লায়ন শাহ আলম বাবুল এবং ফাউন্ডেশনের ট্রেজারার লায়ন এস জোহা চৌধুরী, লায়ন্স আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও একাডেমিক ডাইরেক্টর প্রফেসর ডা. প্রকাশ কুমার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আজীবন সদস্যদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট লায়ন সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি লায়ন ডা. দেবাশীষ দত্ত। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফাউন্ডেশনের এসোসিয়েট সেক্রেটারি লায়ন এস এম আশরাফুল আলম আরজু।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চিটাগাং লায়ন্স ফাউন্ডেশন যে ধরনের স্বচ্ছতা, মানবিকতা এবং একাগ্রতা নিয়ে কাজ করছে তা ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠান একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। একদিন সিএলএফ শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের জন্য রোল মডেল হয়ে উঠবে।

তিনি বলেন, বিশ্বে চিকিৎসার জন্য নিজের পকেট থেকে টাকা প্রদানকারী মানুষের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আফগানিস্তানের চেয়েও এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এটা খুবই লজ্জাজনক। আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে জাতিগতভাবে আমরা পুরোপুরিভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমাদের বাজেটের খুব একটা ছোট অংশ স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ থাকে। শিক্ষার জন্য বরাদ্দও একেবারে কম। যেটুকু বরাদ্দ হয় তার একটি বড় অংশ দুর্নীতি খেয়ে ফেলে। এজন্যই আমাদের জনগণকে নিজেদের পকেট থেকে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাতে হয়।

খসরু বলেন, যা সরকার পারেনি তা লায়নিজম করছে। সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, নিম্নআয়ের মানুষ চোখের আলো ফিরে পাচ্ছেন। এটা অনেক বড় একটি কাজ। তিনি বলেন, আমরা আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে যে পরিমাণ স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল তা পারিনি। আগামীতে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব। আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াব, মনোযোগ দেব।

তিনি বলেন, আমাদের হেলথ সেক্টরে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন। যা সুযোগ ছিল তা করা হয়নি। সামনের দিনগুলোতে করতে হবে। এটাকে সাপ্লিমেন্টারি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। চিটাগাং লায়ন্স ফাউন্ডেশন যেভাবে এগিয়ে এসে মানুষের জন্য কাজ করছে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের আমি ধন্যবাদ জানাই।

বিএনপির এই নেতা বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের এমন অবস্থার মাঝে সিএলএফ দেশের মানুষের অন্ধত্ব নিবারণে যেভাবে কাজ করছে তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এখানে একজন ক্লিনারকে সম্মাননা দেওয়া হলো; যা দেখে আমার এত ভালো লাগল যে, বলে বোঝাতে পারব না। তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠান এমন একটি কাজকে স্বীকৃতি দিতে পারে, সেটি অবশ্যই একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান; সেবার প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান যদি মানবিক হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের সব কাজও মানবিক হয়ে যায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সিএলএফ একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গত অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে মানবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। সামনের দিনগুলোতে এই কর্মকাণ্ড আরো বিস্তৃত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, একটি কোয়ালিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যদি স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করা যায়, তাহলে শুধু দেশের নয়, দেশের বাইরের দাতারাও দান করতে উৎসাহিত হয়।

ফান্ডিং নেভার এ প্রবলেম’ মন্তব্য করে আমীর খসরু বলেন, প্রবলেম হচ্ছে আমরা সেই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বিশ্বমানের সেবা দিতে পারছি কিনা। যদি আমরা বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সেবা দিতে পারি তাহলে ফান্ডিং কোনো সমস্যাই নয়। আমি এখানে যে ডেডিকেশন দেখছি, যতগুলো নিবেদিতপ্রাণ মানুষ দেখতে পাচ্ছি, তাতে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। বাংলাদেশের লায়নিজমের জনক এম আর সিদ্দিকীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা সিএলএফকে আরো সামনে এগিয়ে নেব। পরিণত করব একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে। এক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে যতটুকু করা সম্ভব তা করব।

সেবার এক অনন্য আদর্শের নাম লায়নিজম’ মন্তব্য করে সাবেক গভর্নর, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক বলেন, লায়নিজম কেবল একটি সংগঠনের নাম নয়, এটি একটি মানবিক আদর্শ, যা সেবার মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় বহন করে। দৃষ্টি হারানো মানুষের চোখে আলো ফেরানো, অভুক্তের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, দুর্বলকে শক্তি দেওয়াএসবই লায়নিজমের মূল চেতনা। আমি বিশ্বাস করি, লায়নিজমের মাধ্যমে আমরা শুধু সমাজে সেবা দিচ্ছি না, বরং বিশ্বকে আরও সুন্দর, মানবিক ও মঙ্গলময় করে তুলছি।

তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ১৪ লাখ লায়ন সদস্য রয়েছেন। আমরা চাইলেই বিশ্বকে পাল্টাতে পারব না। তবে আমরা যদি একজন করে মানুষের মুখেও হাসি ফোটাতে পারি তাহলে ১৪ লাখ লোক হাসবে। যা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও চিহ্ন রাখবে। মানুষ চলে যাবে, কেউই থাকবে না। তবে এই চিহ্ন রেখে যাওয়াটাই আসল কাজ। এটাই লায়নিজম।

আজাদী সম্পাদক বলেন, লায়নিজমের শক্তি এর নিবেদিত সদস্যদের মধ্যে নিহিত, যারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। একটি সুন্দর ও মানবিক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না, কেউ অবহেলিত হবে না।

লায়ন এম এ মালেক মুম্বাইয়ের ৯০ বছরের এক বৃদ্ধের কর্ণিয়া লাগানোর আবেদন করার গল্প তুলে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, তখন কর্ণিয়া এত সহজে পাওয়া যেত না। শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া দুটি কর্ণিয়ার একটির জন্য ৯০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি আবেদন করেন। পরে সাক্ষাৎকারের সময় উনি লায়ন নেতৃবৃন্দকে বলেন, আমার নাতি সারা দিন আমাকে ‘দাদা দাদা’ বলে ডাকে। তাকে কিন্তু আমি দেখি না। শুধু নাতিকে দেখার জন্য ঘণ্টাখানেকের জন্য হলেও কর্ণিয়াটি তাকে দেওয়ার আকুতি জানান। লায়ন নেতৃবৃন্দ ওই বৃদ্ধকে কর্ণিয়া দিয়ে নাতিকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটাই লায়নিজম।

চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশন ও লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের কার্যক্রমকে অনন্য উচ্চতায় এগিয়ে নিতে এবং কানাডিয়ান সংস্থা জেকো ফাউন্ডেশন ও লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের ‘ভিশন গ্রান্ড’ প্রাপ্তি ও প্রকল্পের কাজ সফলভাবে সম্পাদনে বিশেষ অবদানের জন্য হাসপাতালের চিকিৎসক ও এমপ্লয়িদের মধ্যে ষোলজনকে ক্রেস্ট প্রদানের মাধ্যমে বিশেষভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন ডা. শাবানা সুলতানা, মোসাম্মৎ ইনসাফি হান্না, ডা. মোহাম্মদ আলতাফ উদ্দিন খান, ডা. মোছাম্মৎ আফরোজা আকতার, ডা. শেখ মোহাম্মদ মুরাদ, ডা. রিফাত আক্তার, মোছাম্মৎ তৈয়বা, আকলিমা খাতুন, আসমা আক্তার, গুলসানা আক্তার, মো. মুনিরুজ্জামান, রূপক চৌধুরী, পাবেল বড়ুয়া, মোহাম্মদ আবু মিনহাজ, বিলকিস আক্তার ও চিনু রানী মল্লিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাফিক বক্সের সামনে গোলাকার বস্তু, বোমা সন্দেহে আতঙ্ক
পরবর্তী নিবন্ধবিক্ষোভের প্রস্তুতি চলতে থাকে সমগ্র পূর্ব বাংলায়