সিআরবি ও আমার মেয়ে

জাহেদ মোতালেব | সোমবার , ২৬ জুলাই, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

আমাদের কাছে পথ বড় নয়, গন্তব্যই আসল। পথ না চিনে, না হেঁটে কোনো প্রকারে শেষটা দেখতে পারলেই বাঁচি। শেষে যে চূড়ান্ত কিছু থাকতে পারে, নিজেদেরকেই ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কিছু, তা মনেই থাকে না। কিংবা থাকলেও আপাত লাভের ও লোভের কাছে আর সব বিবেচনা তুচ্ছ হয়ে যায়।
সিআরবিতে ওরা হাসপাতাল বানানোর চেষ্টা করছে। এত বাদ-প্রতিবাদের পরও এখনো উচ্চ তরফ থেকে কোনো ঘোষণা এল না।
অনেক বছর আগে বর্ষায় সিআরবিতে হাঁটতাম। সিআরবির খুলে যাওয়া রূপ দেখতাম। আজও বৃষ্টিভেজা সকালে এসেছি এখানে। হাঁটতে হাঁটতে ভেজা বড় গাছটাকে ছুঁয়েছি। তার গায়ে ছোট ছোট কুঁড়ি। অন্য গাছ, আগাছা এসে এখানে আশ্রয় নেয়। ওরা আমাকে চিনতে পেরেছে। আমিও আকুল হয়ে হাত বুলালাম। পথে পথে হাঁটলাম, ঘাসে ঘাসে বৃষ্টির মেলে দেওয়া ডানা দেখলাম।
বড় বড়, ছোট ছোট ফোঁটা আমাকে মনে করাল নানা জাতের গাছের কথা। নরম নরম ওই মাটি, সেই মাটিতেই বসে পড়লাম। থাক ভিজে যাক, পুরো শরীরটাই ভিজে যাক। ভিজে ভিজে আমিও মাটির মতো হয়ে যাই। এই মাটির ঘ্রাণ অনেক পুরনো। আমার ভালো লাগছে, শান্তি শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি অনেক দিন পর নিজের কাছে ফিরে এসেছি। আমার ভেতর আশ্চর্য এক নীরবতা তৈরি হয়েছে। নিঝুম এক ঘর তৈরি হয়েছে। সেখানে চুপে চুপে গাছের হাওয়া আসে, পাখির পালকের বাতাসেরা আসে। এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
তখন আমার মেয়ে ডাক দেয়, বাবা।
বহুদূর থেকে জেগে উঠি আমি। মানুষের কলরব, হট্টগোল ভালো লাগে না।
গ্রামে গেলেই সে জিজ্ঞেস করে, বাবা, তোমার শহরে কী আছে?
আমার শহর! আমি অবাক হই।
সে মিটিমিটি হাসে। গা ঝাঁকি দিয়ে বলে, বলো না।
আমি ভাবতে বসি। কর্ণফুলীর কথাই প্রথম মনে পড়ে। দখলে, দূষণে ভরাট হয়ে যাওয়া, তলদেশে পলিথিনের জঞ্জালের যে নদী, সে তো আমার অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
সে আমাকে অত সময় দেবে কেন? গা ধরে ঝাঁকি দেয়।
মনে পড়ে, গত বছর পহেলা বৈশাখে ওদেরকে নিয়ে ডিসি হিল, সিআরবি আর নগরীর খোলামেলা পথে ঘুরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পারিনি।
খোলা পথের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়েছিল, খোলা পথ তো নেই, যেখানে ইচ্ছেমতো হাঁটা যায়, নিশ্বাস নেওয়া যায়। চাটগাঁ শহরে বড় কিছু, বিশাল কিছুর সামনে যে মাথা নোয়াব, বিহ্বল হব, তা নেই বললেই চলে। আশ্চর্য এই শহর, এখানে পাহাড়গুলো কেটে ফেলা হয়, নগরের পেটের ভেতর থাকা আঁকাবাঁকা খালগুলোকে খেলনার মতো বুজিয়ে ফেলা হয়। পুকুর হারিয়ে যায়। বড় বড় মাঠগুলোকে টুকুস করে খেয়ে ফেলে দৈত্যরা। আমরা ‘বাহ! বেশ’ বলে হাততালি দিই। তাই মেয়েকে আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
আমার মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। খালার বাড়িতে একটা খাল ছিল। ওরা বলে মরা খাল। স্রোত নেই তাই এই নাম। টলটলে জল, শীত এলেই ভাগ করে আঁটি দিয়ে মাছ ধরা হত। বর্ষায় জলে টইটম্বুর। কিছুদূর পরপর একেকটা ঘাট। ওখানে সবাই গোসল করত।
কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। খালা-খালু দুজনেই চলে গেছেন পরপারে। এখন গ্রামে দরিদ্র লোকের সংখ্যা কম। প্রত্যেক পাড়ায় পাকা বাড়ির সংখ্যা বেশি। আর বাড়ির টয়লেটের কি টিউবওয়েলের পাইপলাইন গেছে ওই খালে। খারাপ পানি পড়তে পড়তে খালের পানি এখন কালো। প্লাস্টিকের বোতল, জুসের বোতল, পলিথিনসহ যাবতীয় আবর্জনায় খালটা ভর্তি। খালটাকে তারা বানিয়েছে ডাস্টবিন।
আমার প্রিয় দেশের সবখানে তো এই একই চিত্র। পুরো দেশটাই যেন একটা ডাস্টবিন। যা কিছু বাংলার প্রাণ, রসদ; সবার জন্য উপযোগী, তার সব দখল আর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। করে ফেলা হচ্ছে। এক সর্বনাশা নষ্টামির খেলায় নেমেছে ওরা। কোনোকিছুই আস্ত রাখবে না। সব ধ্বংস করে দেবে। হ্যাঁ, দৈত্যের মতো সব গিলে ফেলবে।
চট্টগ্রাম শহর আমার মনের কতটুকু জায়গায় দখল করে আছে, তা টের পেয়েছিলাম দূরে গিয়ে। সেবার আমি গাজীপুরে কয়েক মাস ছিলাম। তখন শুধু মন টানত। ইচ্ছে হত, আজই সব ছেড়েছুড়ে চলে আসি। এসে শহরের পথে পথে হাঁটি। আমার আপন শহরের ছোঁয়া নিই।
কিন্তু গত বিশ-পঁচিশ বছরে শহরটা অনেক পাল্টে গেছে। এই পাল্টানোর ফলে শহরটা অনেক দূরের হয়ে গেছে। একে এখন চিনতে কষ্ট হয়। এ যেন ক্যান্সার আক্রান্ত এক মানুষ, যার হাড়গুলো হয়ত অবশিষ্ট আছে। এই শহরটাকে আমরা মমতা দিয়ে গড়তে পারিনি। হ্যাঁ, এটাই হলো কথা। আমাদের মধ্যে মমতা নেই, আমরা কী দিয়ে শহর গড়ছি? শুধু কতগুলো ইট, পাথর, দেয়াল, গ্রিল। যেখানে সবুজ দেখি, তা শেষ করে দিই।
বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, এই শহর যখন আমার মেয়ের শহর হবে, তখন এখানে কী থাকবে? কোনো মাঠ কি থাকবে? বড় বড় গাছগুলোর কী হবে? খোলা জায়গা বলে কিছু থাকবে? দালানে দালানে এই শহরের আকাশটা ঢেকে যাবে না? একটু আলোর জন্য বুকটা ছটফট করবে না? নিশ্বাস নিতে কি কষ্ট হবে না?
আমি আর ভাবতে পারি না। আমার কেমন কষ্ট হয়। চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপ দেখে যেতে হয়েছে। কিছুই করতে পারিনি। এত অক্ষম! অক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান। আমার মেয়ের শহর কেমন হবে তা আর ভাবতে পারছি না। ভাবতে গেলে কারা যেন চোখের সামনে দাঁড়াচ্ছে, মনের সামনে দাঁড়াচ্ছে। দৃশ্যের পথ রোধ করে তারা হাসছে। বলছে, তোমার আর কিছুই নেই। সব আমাদের। আলাদিনের চেরাগ আছে আমাদের কাছে। আমরা যা হুকুম করি তা-ই হয়।
আমি তখন অসহায় চোখে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবরের দিকে তাকাতে চেষ্টা করি। শহীদের স্মৃতিধন্য এই মাটি, এক মুঠো মাটি নিয়ে তাদের মুখে ছুড়ে দিতে চেষ্টা করি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সেই বিপ্লবীদের ডাকতে চেষ্টা করি।
একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে একটি দেশকে স্বাধীন করেছে মাটিমাখা সন্তানেরা। প্রকৃতি ধ্বংস করা, নদী আর পাহাড় ধ্বংস করা দেশটা নিশ্চয় তাদের কল্পনায় ছিল না। ছিল কি? বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কে করবে? কে দেবে এর নিরাপত্তা?

আমরা কেন এমন সর্বনাশা হয়ে উঠছি? এই প্রশ্ন কাকে করব? লোভের পাহাড়ে উঠে বসে আছে ক্ষমতাবানরা। এখানে সর্বনাশা এক হাওয়া সব ভাসিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দূষিত করে দিচ্ছে। কর্ণফুলীর নিচে জমে যাওয়া পলিথিনের মতো আমরা আটকে যাচ্ছি। আমরা নিশ্বাস নিতে পারছি না।
আমাদেরকে নিজেদের মতো একটু বাঁচতে দাও। যে উন্নয়নে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায় সেই উন্নয়ন চাই না। আমার গাছ, আমার নীরবতা, আমার প্রশান্তিকে বাঁচিয়েই যা চাওয়ার চাই।
আমি হাঁটি। বুক ভরে সিআরবির ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করি। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মনটাকে পূর্ণ করার চেষ্টা করি। জানি, এখানকার অনুপম ও প্রশান্ত এই পরিবেশ, এটা কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। এখানকার হাওয়ায় হাওয়ায় সেই ধ্বনিই শুনতে পাই আমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরেকর্ড জয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজও বাংলাদেশের
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাযুদ্ধে ১৯৫ দেশের মধ্যে সেরা ২০-এ বাংলাদেশ