‘আঁরা মাইনতাম ন, কতা উইনতাম ন, সিআরবির সোনার দেহত হাত লাগাইতু দিতাম ন। সিআরবির শিরীষ তলা ঐতিহ্য চট্টলার, শতবর্ষর নানান স্মৃতি বহন গড়িবার। জান থাকিতে গাছর গোড়াত কুড়াল মাইরতু দিতাম ন।’- ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। তা উপেক্ষা করে সিআরবি থেকে ভেসে আসছে শিল্পী আলাউদ্দিন তাহেরের এ গান। গতকাল বৃষ্টির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এভাবেই বহু দূর থেকেই ভেসে আসছিল উত্তাল প্রতিবাদে শামিল হওয়ার ডাক। ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আসছে মানুষ একা কিংবা দল বেঁধে। মিশে যাচ্ছে জনস্রোতে, অভিন্ন আবেগে। লাল সবুজের চেতনায় শাণিত এ প্রজন্ম আজ এক কাতারে নিয়ে এসেছে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ঢল। হাতে প্ল্যাকার্ড, কণ্ঠে উদ্দীপনার মন্ত্র, কখনো বা প্রতিবাদী গান অথবা কবিতার শাণিত পংক্তিমালা। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল সিআরবি এলাকা। জনস্রোত হৃদয়ে মননে চিন্তায় প্রতিবাদে একাকার হয়ে গেছে। সকলের এক ও অভিন্ন মত, ‘না নিতে পারি যদি শ্বাস, হাসপাতালতো নাভিশ্বাস’। সিআরবিতে গতকাল বক্তারা বলেন, যখনই অস্তিত্বের সুতোয় টান পড়ে তখন তরুণ সমাজ নিজেরাই নিজেদের অধিকার আদায়ে এভাবেই নেমে পড়ে রাজপথে। দাবি আদায়ে জান বাজি রেখে লড়ে যায় শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছিল এ জাতি, মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সামরিক বাহিনী ও তার এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করে এ জাতি বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া, দলীয় সংকীর্ণতা আর দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র আমাদের টুঁটি চেপে ধরতে ওঁৎপেতে আছে সব সময়। সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমরা আটকে পড়েছি বারবার। যতোবারই এমন দুঃসময় এসেছে জাতির সামনে, জনতার ঐক্য আবারো বাঁচার প্রেরণা যুগিয়েছে। এবারও চট্টগ্রামবাসী এক হয়েছে ‘সিআরবি বাঁচাও’ আন্দোলনে। এ আন্দোলনে ভেসে যাবে কথিত বেনিয়া গোষ্ঠী।
সিআরবি ঘুরে দেখা গেছে, নারী-পুরুষ, শিশু, বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে সিআরবি। পুরো এলাকা প্রতিবাদী জনতার দখলে। অনেকের মাথায় বাঁধা জাতীয় পতাকা। কারো পরনে সিআরবি রক্ষার স্লোগান সমৃদ্ধ টি শার্ট। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা।
সিআরবি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের কার্যনির্বাহী সদস্য সজল চৌধুরী এসেছিলেন প্রতিবাদে শামিল হতে। তিনি আজাদীকে বলেন, চেতনায় শাণ দিয়ে যৌবনের দূত তরুণ সমাজ আজ জেগেছে সেই একাত্তরের মতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেছিলেন সবুজ, কাঁচা। আধ মরা এ জাতিকে ঘা মেরে বাঁচানোর আয়োজন চলছে সর্বত্র। কবির ভাষ্য মতে, আগুন আর শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। পরে তারা শক্তি সঞ্চয় করে জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তাই সিআরবি বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অরাজনৈতিক এই আন্দোলনে মানুষের প্রাণের দাবির মহামিলন ঘটেছে। সময়ই নির্ধারণ করে দেবে এ আন্দোলনের শেষ কোথায় হবে।
এসেছিলেন স্কুল শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর মাহবুব। আজাদীর কাছে অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, যে আশার আলোর আশায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই ভূখন্ড ‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়েছিল এতবছর পরে এসেও সেই আশা-ভরসা লুণ্ঠিত হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও এটা এখনও বাস্তব সত্য যে, আমাদের দেশে এখনও কিছু দুর্বৃত্ত ঘাপটি মেরে আছে যারা সামান্য ক’টা টাকার বিনিময়ে দেশের স্বার্থকে ভুলুন্ঠিত করতে চায়। শতবর্ষের পুরোনো গাছ কেটে ধ্বংস করতে চায় আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। এইসব ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজের স্বার্থ খুঁজে। কিন্তু এর প্রতিরোধ এবং বিচারের দাবিতে আমরা প্রতিবাদ করি না। তরুণরা সে কাজটি করছে। সরকারের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভুলগুলি। এদের পাশে থাকা উচিৎ আমাদের সবার।
গতকাল সিআরবির রক্ষার আন্দোলনে দিনব্যাপী অংশ নিয়েছিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠন। এগুলো হলো উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ চট্টগ্রাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক স্কোয়াড চট্টগ্রাম, গ্রিন অ্যালয়েন্স বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন চট্টগ্রাম নগর, বাণীগ্রাম ইয়ূথ মুভমেন্ট, নবযুগ মা দূর্গা ফাউন্ডেশন, সারাবাংলা ৮৮, অ্যাডলোসেন্ট এন্ড ইয়ূথ ফোরাম, দুর্নীতি বিরোধী সংগ্রাম পরিষদ, এক্টিভিস্টা চট্টগ্রাম এলআরপি ৪৮, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরাম, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ চট্টগ্রাম, সম্মিলিত বাগান গ্রুপ চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম’ ৯৪, বিন্দু ফাউন্ডেশন, গোয়ালপাড়া এলাকাবাসী, লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগং মেট্রোপলিটন, বাংলাদেশ ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ, নরেন আবৃত্তি একাডেমি, চট্টগ্রাম সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবী ফোরাম, শতায়ু অংগন, ডিসি হিল, চট্টগ্রাম, সাংস্কৃতিক মিডিয়া ঐক্য জোট, পথিক ৭১, চট্টগ্রাম বাইকিং গ্রুপ ও যত দূর গলা যায় ব্যান্ড।