হাসপাতাল দরকার কিন্তু চট্টলার ফুসফুস চিরে নয়
ববি বড়ুয়া
বরাবরই প্রকৃতি আমার প্রেমের অংশ। তার কাছে যেতে মন সবসময় উচাটন থাকে। প্রতিদিন সম্ভব না হলেও যথাসম্ভব বিকেলে নিয়ম করে হাঁটতে যাই সিআরবিতে। কখনো ছেলে বা কখনো মেয়েকে নিয়ে যাই সাথে। কানে হেডফোনে রকমারি গান আর প্রকৃতির অকৃপণভাবে ঢেলে সাজানো সৌন্দর্য আমাকে চুম্বকীয় কায়দায় কাছে টানে। প্রশস্ত পথ আর বৃদ্ধ বৃক্ষরাজি মন আর শরীরকে আরাম দিতে বদ্ধপরিকর থাকে যার জন্য অনেক হাঁটার ক্লান্তি জেঁকে বসতে পারে না বরং ফুরফুরে আমেজ জাগে সারা শরীরে।
হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে নানা দৃশ্যপট। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা নানা জাতের বয়স্ক বৃক্ষের গোড়ায় বসে অফিস সেরে যাওয়ার পথে বা পূর্বে নির্ধারিত বোঝাপড়ায় আসা প্রেমিক যুগল একে অপরের মুখে তুলে দেয় সঙ্গে আনা খাবার। এমন প্রেমের নির্ভেজাল স্বর্গীয় দৃশ্যপট আমার চোখকে এতোটাই প্রশান্তি দেয় যে যতদূর যাই দেখতে দেখতেই যাই।
কতদূর গেলেই চোখে পড়ে শিরিষ তলায় ইট-পাথরের ঘিঞ্জি দম আটকানো শহরের বিভিন্ন জায়গা হতে ছুটে আসা কিশোর-তরুণদের প্রাণের উচ্ছ্বাসে মন মাতানো খেলা। একই সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে চলে বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
এই সিআরবিতে নিয়ম করে হাঁটতে হাঁটতে এর গা চিরে বেড়ে ওঠা গুল্মলতা, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা শত বছরের পুরানো ক্ষয়ে যাওয়া সেঁতসেঁতে সিঁড়ি, ইংরেজদের শাসনামলের কালের সাক্ষী হয়ে এখনো সগৌরবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা দালান, বড় বড় রেল কর্মকর্তাদের বাসভবন সব কিছুর প্রেমে পড়ে গেছি। শুধু কি তাই, শত বছরের শত সহস্র ইতিহাসের সাক্ষী বয়স্ক বৃক্ষরাজি যাদের গায়ের কাছে গেলেই নির্ভরতার শেষ আশ্রয় মায়ের মতো স্বস্তি ও শান্তি উভয়ের স্বাদ পাওয়া যায়, প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়া যায়। তাদের কাছে ঠিকঠাক আসতে না পারলে মনে হতে থাকবে এই বুঝি দম আটকে প্রাণবায়ু এখনই উড়ে যাবে।
এর প্রতি প্রেম আমার বা আমার মতো হাজার, লক্ষ প্রকৃতিপ্রেমীর মধ্যে এতোটাই জেঁকে বসেছে যে আমার মনে হয় এখানে যেতে না পারলে বা এর সৌন্দর্য নষ্ট হলে বা তার গায়ে আঘাত হানা হলে তা কেউ মেনে নেবে না। এটি শুধু সিআরবি নয়, এটি এখন প্রেম আর প্রাণের জায়গা। সুতরাং চট্টলবাসীর প্রাণ নিয়ে খেলা নয়। হাসপাতাল দরকার কিন্তু চট্টলার ফুসফুস চিরে নয়।
কতিপয় ধান্দাবাজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে দেয়া যায় না
জসীম মেহবুব
এর আগে একবার বিজয়মেলা বন্ধ করে দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে অনিন্দসুন্দর সার্কিট হাউজের সামনে সবুজ চত্বরে কৃত্রিম শিশুপার্ক তৈরি করে আমাদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেদিন তারা বিফল হয়েছে। মাঝখানে আমরা হারিয়েছি নান্দনিক সবুজ খোলা মাঠ। এবার ওরা হামলে পড়েছে সিআরবি এলাকায়। আমরা জেগে আছি। চট্টগ্রামের প্রতিবাদী মানুষ কখনোই এই অপতৎপরতা চালাতে দেবে না। যারা এইসব আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের চিনে রাখা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে এরা নিজেদের সাধুপুরুষ দাবি করে আবার নেমে পড়বে অন্য কোন অশুভ কাজে। কতিপয় অসাধু ধান্দাবাজের ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই চরিতার্থ করতে দেয়া যায় না। হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধি আমরা নই। প্রয়োজনে দশটি হাসপাতাল নির্মাণ করুন। তাই বলে শহরের ফুসফুস ধ্বংস করে নয়। চট্টগ্রামে আরও অনেক জায়গা রয়েছে। সেখানে অনায়াসে হাসপাতাল নির্মাণ করা যায়। সব ষড়যন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে আমরা আমাদের ফুসফুসকে রক্ষা করবোই। এ আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার। আসুন, বাঁচাই প্রকৃতি বাঁচাই দেশ। ওরা ব্যর্থ হবে, হবেই হবে ।
পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ
লামিয়া ফেরদৌসী
মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় নিয়ামক নিঃশ্বাস। বিজ্ঞানের ভাষায় অক্সিজেন, যা বাতাসে শতকরা ২০.৭১% থাকা জরুরি। বাতাসে অক্সিজেন কমতে শুরু করলে বেড়ে যেতে শুরু করে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস। সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রোল এর বহুল ব্যবহার, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন চালিত গাড়ির ধোঁয়া, মহামারীর মতো বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রতিনিয়ত বাতাসে বেড়ে যাচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড, অ্যালডিহাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড সহ সিসার নিঃসরণ বেড়ে বাতাসকে দূষিত বিষে পরিণত করে চলেছে। মারাত্মক এই বায়ু দূষণের কারণে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে হাঁপানি (অ্যাজমা), সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাক্টিভ পালমোনারি) সহ ফুসফুসের ক্যান্সারসহ ক্ষতিকর সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমান শহরাঞ্চলের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত এই বিষ গ্যাস। আমরা প্রতিনিয়ত এই বিষ ফুসফুসে বহন করে নানাবিধ রোগ জীবাণুতে আক্রান্ত হচ্ছি। চট্টলাবাসীর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ এই ‘সিআরবি’। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা বিশাল কালের সাক্ষী বহন করা বৃক্ষরাজির দাপুটে হাওয়াই এখন হয়ে ওঠেছে একমাত্র শ্বাসক্রিয়া গ্রহণের জায়গা। বেসরকারি হসপিটালের নামে চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত এই অংশটি কেটে ফেলা মানে, বন্দরনগরীকে বিষাক্ত বিষবাষ্পে ভরিয়ে তুলা বৈ আর কিছুই না। দূষণ ও যান্ত্রিকতার এই নগরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত বছরের ঐতিহ্য মণ্ডিত বিরাট বিরাট বৃক্ষরাজি বেষ্টিত সিআরবির সবুজতা নষ্ট করে হসপিটাল নির্মাণের উদ্যোগ পরিবেশের তথা মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
চট্টগ্রামবাসী জেগেছে
ছাইফুল হুদা ছিদ্দিকী
দেরীতে হলেও চট্টগ্রামবাসী জেগেছে, আন্দোলন করবে করবে ভাব দেখা যাচ্ছে। যমুনা টিভির ১৪ জুলাই এর একটি আলোচনা শুনছিলাম। প্রাণবন্ত কথামালা সব প্রিয় মানুষের। চট্টগ্রামের সত্যিকারের উন্নয়ন প্রত্যাশী সবাই একই সুরে বললো চট্টগ্রামে হাসপাতাল চাই, তবে পাখি ডাকা সবুজের মায়াময় পরিবেশ ধ্বংস করে শিরিষতলায় নয়। আধুনিক বিশ্বমানের হাসপাতাল হোক চট্টগ্রামের অন্য কোন সুবিধাজনক এলাকায়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক ও ঐতিহাসিক স্থান রেলওয়ের এই জায়গাটি। সম্প্রীতি রক্ষার অতন্দ্র সব মানুষের মাঝে পুরো জাতি ধর্ম ভেদাভেদ দূর করে যোগাযোগ ও সংস্কৃতির বহনে সেতু হিসেবে কাজ করছে এই এলাকাটি। পহেলা বৈশাখ এর অনুষ্ঠান সহ নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সারাটি বছর চট্টগ্রামের মানুষের একমাত্র স্থান এখন এই ঐতিহাসিক জায়গাটি। সাত রাস্তার মোড় এই সিআরবি চট্টগ্রামের নাভি। এখানে পাখির কলতান, সুনসান নীরবতা সবুজের সমাহার দারুণ সব অলংকরণ মানুষ মুক্ত জায়গায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। এটা বলা যায় চট্টগ্রামের অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এরকম সবুজে ঘেরা জায়গা আর নেই। দেরীতে হলেও চট্টগ্রামের সচেতন মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আশা করি আন্দোলন দেরীতে হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সবকিছু আবার ভালো করে সরেজমিনে দেখে শুনে প্রস্তাাবিত হাসপাতাল শিরিষতলায় নয় চট্টগ্রামের অন্য কোন সুবিধাজনক জায়গাতেই নির্মাণ করবেন।
চট্টগ্রামের জন্য গ্লানিকর
শিপ্রা দাশ
হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। যেখানে রয়েছে সাগর, নদী ও পাহাড়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ক্রমে ক্রমে এ চট্টগ্রামের নান্দনিকতা অবলুপ্তির পথে।যা শুধু দুঃখজনক নয়, গ্লানিকরও বটে। চট্টগ্রামকে প্রকৃতির লীলাভূমি যে বলা হতো। সিআরবির কল্যাণেই তার কিছুটা টিকে আছে। চট্টগ্রাম শহরের ‘ফুসফুস’ নামে খ্যাত এই সিআরবিতেই সরকারি বেসরকারি চুক্তি পরবর্তী উদ্যোগে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
এরই মধ্যে ডি সি হিলে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় সিআরবিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গুলো হতো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার মতো দৃষ্টি নন্দন এতো বড় জায়গা তো আর নেই।এই একটিমাত্র জায়গা যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনো বিদ্যমান।যদিও এখন অনেক টা ম্লান। তারপরও যেটুকু আছে, এটিকে ধ্বংস করার জন্য কেন এই অপপ্রয়াস? সরকার যদি হাসপাতাল তৈরি করতে চায়, সেখানে যে রেলওয়ে হাসপাতালটা আছে, নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা নতুন জায়গায় না করে এই হাসপাতাল কে আরও একটু উন্নয়ন করে পরিসরটা বাড়িয়ে সেখানে রেলওয়ের মানুষ জন ছাড়াও সাধারণ মানুষের সেবার সুযোগ তৈরি করা সমীচিন হবে। হাসপাতাল হলে সেখানে বহু মানুষের সমাগম হবে। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে দোকান পাঠ। বাড়বে গাড়ির দৌরাত্ম্য। যেখানে আমরা এখনো হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণের ভালো ব্যবস্থাপনা করতে পারছিনা। এখানে হাসপাতাল হওয়া অর্থাৎ ‘চট্টগ্রাম শরীরে সিআরবি নামক ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টির ব্যবস্থা করা।’ দয়া করে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন এবং সুদূর ভবিষ্যতে যেন এখানে কোন ধরনের নতুন স্থাপনা গড়ে উঠতে না পারে তাইজন্য সিআরবি কে ‘রিজার্ভ ফরেষ্ট’ ঘোষণা করা হোক।
আসুন, আমাদের নিঃশ্বাসের জায়গাটুকুর জন্য লড়াই করি
ইশতিয়াক জাহাঙ্গীর
জাতি হিসাবে আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। একজন সচেতন মানুষ হলে আপনি তা অস্বীকার করতে পারবেন না। সেই দুর্বল চেতনার কিছু মানুষের মগজ নির্গত এক ঐতিহ্য বিরোধী সিদ্ধান্ত হল দু’শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন আমলের দাঁড়িয়ে থাকা অল্প কিছু ভবন এবং তার চারপাশ ঘিরে থাকা শতবর্ষী বৃক্ষের অপার প্রান্তর কেন্দ্রীয় রেলওয়ে বিল্ডিং তথা আমাদের প্রাণের স্পন্দনে দোলায়িত সিআরবিতে নির্মাণের নামে ধ্বংস চালানো।
বিশ্বের প্রতিটি দেশ যখন তুমুল চেষ্টা করছে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে আপ্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে, সেখানে আমাদের কতিপয় আমলার দুষ্ট বুদ্ধি জেগেছে শাশ্বত ঐতিহ্যের এই স্মারক ধ্বংস করে সেখানে মানবতার মুখোশ পরিয়ে জনগণকে বেকুব বানিয়ে হাসপাতাল নির্মাণের নামে এই বিস্তৃত ইতিহাস আর ঐতিহ্য নষ্ট করতে।
তা আপনাদের এই অতি মানবিক খায়েশ মিটানোর জন্য পাশেই অবস্থিত রেলওয়ে হাসপাতালটিকে কেন আধুনিকায়ন করছেন না? তার মানে উদ্দেশ্য অন্যত্র। কি হতে পারে তা?
বেশ কয়েক বছর ধরে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখসহ সংস্কৃতির আরও কিছু কর্মকাণ্ডের উৎসস্থল হয়ে উঠেছে সিআরবির এই মনোরম শিরিষতলা। হয়ত কেন বলি, এটুকু নিশ্চিত – বাঙালি সংস্কৃতির এই চলমানতা প্রশাসনে ঘাপটি মারা বিজাতীয় মানসিকতার কারো কারো সহ্য হবার নয়। শেষবার যখন এখানে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হচ্ছিল, তখন এক কর্মকর্তা হাজির হয়ে মাইক বন্ধ করে দেবার সেই দাম্ভিক আচরণের কথা আপনারাও নিশ্চয় ভুলে যাননি। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধ্বংসের এক সুবিশাল চক্রান্তের অংশ হিসাবেই সিআরবির এই খোলা প্রান্তর আজ শকুনদের তীক্ষ্ণ টার্গেট। তবে শেষ কথা হচ্ছে, অগ্নিগর্ভা চট্টলার জাগ্রত জনতা সদা জেগে আছে, সেটুকুই ভরসা। আসুন সবাই মিলে আমাদের নিঃশ্বাসের জায়গাটুকুর জন্য লড়াই অব্যাহত রাখি।
সিআরবি বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান
সাজিদা জেসমিন
সিআরবি….। নগরীর প্রাণকেন্দ্র বলবো কিনা জানি না, তবে জায়গাটার প্রতি আলাদা একটা টান বোধ করে সবাই। সবুজাবৃত, ছায়া-শীতল এই জায়গায় আপনা-আপনি মানসিক প্রশান্তি মেলে। শহুরে যান্ত্রিক জীবনের মাঝে একটু প্রশান্তির খোঁজে অনেকেই সিআরবি নামক জায়গাটায় গিয়ে ভিড় জমায়। চারপাশে সবুজ, উঁচু-নিচু পাহাড়, বিশাল বিশাল সব বৃক্ষ, সাত রাস্তার মোড়, পাশঘেঁষা রেলওয়ে অফিস, পিচ বাঁধানো রোড, বিশাল খেলার মাঠ সব মিলিয়ে দারুণ একটা পরিবেশ। সকালবেলা বলুন আর বিকেলবেলা তরুণ-প্রবীণদের প্রাকৃতিক সংস্পর্শে এসে ব্যায়াম করার মতো দারুণ একটা জায়গা এটা। মাঠে বাচ্চাদের খেলাধুলা চলে প্রায়ই। চারপাশ ঘিরে দেওয়া সিঁড়িতে জমে আড্ডার আসর। কখনোবা কোন সামাজিক সংগঠন, কখনোবা বন্ধু মহল, কখনোবা কোন বিশেষ জমায়েত, সব মিলিয়ে সিআরবি সবসময় প্রাণবন্ত থাকে। যার সাক্ষী হয়ে থাকে বিশাল বিশাল বৃক্ষগুলো। শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে থাকা শতবর্ষী এই বৃক্ষগুলো চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। তরুণ বলুন, বৃদ্ধ বলুন আর শিশু বলুন, সবাই যেন যান্ত্রিকতা পেরিয়ে এই জায়গায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। শহুরে পরিবেশে একটু শান্তির ছোঁয়া। যা মুহূর্তেই অশান্ত মনকে ফুরফুরে করে তোলে। প্রবীণদের মনে জাগায় তারুণ্য। তারুণ্যের মনে জাগায় এগিয়ে চলার শক্তি। এখানে বসেই ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণেরা আগামীর স্বপ্ন বুনে, কেউবা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে এখানে বসেই। সবাই উন্নয়ন চায়, হাসপাতাল চায়। কিন্তু যান্ত্রিকতার ভিড়ে লুকিয়ে থাকা এই অক্সিজেন ভাণ্ডারকে ক্ষত করে কেউ এই উন্নয়ন চায় না। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানান জায়গা। একটু সদিচ্ছা থাকলেই স্থান পরিবর্তন করে সিআরবিকে রক্ষা করা সম্ভব যান্ত্রিকতার বেড়াজাল থেকে। আশা করি কর্তৃপক্ষ আরো একবার ভেবে এই ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তই নিবেন। সিআরবি বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান।
অশুভ কর্মক্রিয়া রুখে দেব
সাহাদাত হোসাইন সাহেদ
সিআরবি এলাকায় বিদ্যমান ৬ একর জমি জুড়ে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ অনভিপ্রেত। ৫০০ শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল ও একশ আসনের মেডিক্যাল হাসপাতাল স্থাপন নির্মাণের জন্য ফুসফুস খ্যাত সিআরবি স্থানকে মেনে নেওয়া যায় না। ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত জনস্বার্থ বিরোধী। আমরা হাসপাতাল নির্মাণে বিরোধী না। সরকারি জমিতে স্থাপনা নির্মিত হলেও পরিচালিত হবে বেসরকারি সংস্থা ইউনাইটেড গ্রুপ নামক প্রতিষ্ঠানের নামে যা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। মন্ত্রী মহলের নানা হুমকি ধমকি ও দৃঢ়তাকে প্রতিবাদ স্বরূপ স্পষ্টই বলছি- সিআরবির দৃষ্টি নন্দন সবুজ ঘেরা নৈসর্গিক সাদৃশ্যকে কর্তন করে বিচ্যুত করতে দেওয়া হবে না। মাননীয় সরকারি মহোদয়, এই সিদ্ধান্ত পরিহার করে জনগণের দাবি গ্রাহ্য করুন। জনগণ ও প্রশাসনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েন না। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বৃক্ষনিধন ও সবুজ ঘাসের চৈতন্য নষ্ট করে চট্টলবাসীর সংস্কৃতি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মিলনস্থান নষ্ট হতে দেব না। প্রয়োজনে মাঠে নামবো, এমন অশুভ কর্মক্রিয়া রুখে দেব।
সিআরবিতে চাই গাছের অক্সিজেন, হাসপাতাল নয়
প্রণব সাহা
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলের সিআরবি ভবনকে ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের গাছপালা, পাশেই পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা আর নজরকাড়া বাংলো। নগরবাসীর কাছে শহরের সিআরবির শিরীষতলার এই জায়গাটি চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বড়সড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে সেই ‘ফুসফুস’ ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষ ঘেরা পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি সকল বয়সী সাধারণ জনগণের প্রাণখুলে মুক্ত বাতাসে হাঁটাহাটি কিংবা ঘুরতে আসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। আশপাশের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণির আবাস। গত কয়েক বছর ধরে ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় পহেলা বৈশাখসহ নানা আয়োজন হয় সিআরবি শিরীষ তলায়। ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ এবং বিনোদনের কেন্দ্রের জন্য এই স্থানটি সর্বদা নগরবাসীর মন কেড়েছে।
বন্দরনগরীর সিআরবি মোড় থেকে টাইগার পাস, কদমতলী ও জিএম বাংলোমুখী সড়কগুলোর দুপাশে রয়েছে শতবর্ষী রেইন ট্রি ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালি।
বন্দর নগরীর সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। পাশাপাশি এটি নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে এই এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে।
চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন নেই। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম এই উন্মুক্ত পরিসরটিও যদি না থাকে, নগরীর সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়! আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে নই। চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক খালি জায়গা আছে, যেখানে হাসপাতাল করা যায়। কিন্তু, যে কোনো মূল্যে সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে।
.
সিআরবি আমাদের প্রাকৃতিক হাসপাতাল
আজহার মাহমুদ
ঢাকার মতো চট্টগ্রামও দিন দিন দালানকোঠায় ভরে উঠছে। চট্টগ্রামের মানুষ একটু নিঃশ্বাস নিতে ছুটে আসে এই সিআরবিতে। এই সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। কিন্তু এখানেই নাকি গড়ে উঠবে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। যা সত্যি পীড়াদায়ক খবর। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকদের বিরোধিতার পরও সিআরবিতে হাসপাতাল তৈরি হয় কীভাবে?
এই সিআরবি সাধারণ মানুষের জন্য একটা দর্শনীয় স্থান। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ চট্টগ্রামে আসলে, সিআরবিতে এসে কিছু সময় বসতে চায়। পুরো চট্টগ্রামের কোলাহল থেকে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ সিআরবিতে আসে। এখানেই হয় সাংস্কৃতিক আড্ডা, প্রিয়জনের সাথে সুন্দর মুহূর্ত পার করা, কিংবা মুক্ত বাতাসে হাঁটা। চট্টগ্রামের এই ফুসফুস যদি মরে যায়, মরে যাবে পুরো চট্টগ্রাম। মানুষ কৃত্রিম শ্বাস চায় না, চায় প্রাকৃতিক শ্বাস। তাই সিআরবিতে নয়, হাসপাতাল হোক অন্য কোথাও।
হুমকির মুখে পড়বে জনস্বাস্থ্য
মো. ফারহাদ আকরাম
ছোটবেলা থেকে আজাদীকে দেখেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও মত প্রকাশে স্বাধীন। সিআরবি প্রাকৃতিক ও অবস্থানগতভাবে সকলের নিকট একটি আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি সহ সময় কাটানোর জন্য এখানে জড়ো হয় তাদের মধ্যে আছে উচ্চ রক্তচাপ, বাড়তি কোলেস্টেরল ও ডায়বেটিস সহ আরো অনেক রোগী যাদের জন্য এ হাঁটাহাঁটি মহৌষধ হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া চট্টগ্রামে নেই কোনো বিকল্প বিনোদন পার্ক বা মুক্ত অক্সিজেন নেয়ার মত জায়গা। এই এলাকায় যদি হাসপাতাল হয় বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ফলে হুমকির মুখে পড়বে জনস্বাস্থ্য, বাড়বে যানজট এবং জনগণ হারাবে সংস্কৃতি চর্চার একটি অঙ্গন। আর সংস্কৃতি চর্চা ব্যাহত হলে জঙ্গীবাদ সহ নানা অপকর্ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন। আমরা আপামর জনসাধারণ এ সিদ্ধান্তের তীব্র ক্ষোভ জানাচ্ছি।
রক্ষা করুন নগরীর হৃৎপিন্ড সিআরবিকে
মোস্তফা কামাল নিজামী
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে নিঃশ্বাস ফেলার মত যে কয়েকটি স্থান আছে তারমধ্যে সিআরবি হলো অনত্যম। এখানে আছে শতবছরের অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য। আছে অনেক পুরনো সারি সারি নানা রকম গাছ। আর এই গাছের নিচে বসে বিশ্রাম ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় এই স্থানটিতে। এমন সবুজ ছায়াঘেরা স্থান চট্টগ্রামে আর কোথায়ও নেই। চট্টগ্রাম নগরীর হৃৎপিন্ড এই সিআরবিকে রক্ষা করতে হবে।
কিন্তু শোনে অবাক হলাম শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এই সিআরবিতে মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপ। আমরা চাই চট্টগ্রামে আরো হাসপাতাল হোক,মেডিকেল কলেজ নির্মাণ হোক। তবে ঐতিহ্যের স্মারক সিআরবির নৈসর্গিক সৌন্দর্য নষ্ট করে নয়। হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের জন্য চট্টগ্রাম শহরে জায়গার কোন অভাব নাই। এভার কেয়ার হাসপাতালের মত বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান যদি শহরের অদূরে অনন্যা আবাসিক এলাকায় গড়ে তুলতে পারে তাহলে ইউনাইটেড গ্রুপ তা পারবেনা কেন? শুধু শতবর্ষী গাছের কারণে নয়, ঐতিহ্যগত কারণেই সিআরবিকে রাখতে হবে অবিকৃত। দেশকে বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালের যেমন গুরুত্ব আছে তেমনি প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রাকৃতিক সবুজবেষ্টিত সিআরবির মত স্থানেরও প্রয়োজন আছে। আর সিআরবির এই গাছপালা কাটা হলে শহরের অন্যতম সুন্দর হারিয়ে যাবে, হারিয়ে় যাবে মানুষের স্বস্তি ফেলার উন্মুক্ত স্থান।
সিআরবিতে হাসপাতাল নয়
সুমন চাটার্জী
আধুনিকতার বেড়াজালে আটকে থাকা দূষণে স্থবির জনজীবনের এক বুক বিশুদ্ধ বাতাস দেয় সিআরবি। চট্টগ্রামের ফুসফুস, সিআরবি। ইট পাথরের রোবটিক জীবনে কিছুটা খোলামেলা পরিবেশ এই সিআরবি। বলা চলে সিআরবি মানুষের বিশুদ্ধতার হাসপাতাল। প্রাণ পরিপূর্ণতায় সতেজ বিশুদ্ধ পরিবেশ, সিআরবি। হাসপাতাল অবশ্যই জরুরি বিষয় কিন্তু সিআরবি এর মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে অবশ্যই না। শতবর্ষী গাছ পালা, পাখপাখালি আর সবুজের সমারোহ প্রকৃতির কোল সিআরবির বিনিময়ে যান্ত্রিক হাসপাতাল অবশ্যই কাম্য নয়।
যান্ত্রিক শহরে এক টুকরো খোলা জায়গা বলতে আমরা শহরের মানুষ সিআরবিকেই বুঝি। পহেলা বৈশাখ মানেই সিআরবির শিরীষ তলা! আহা শহুরে সভ্যতা তার আদি অকৃত্রিম বাঙালিয়ানায় ফিরে যায় এই দিনে সিআরবিতে। হাজারো তরুণ তরুণী আর মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে এক চিলতে উৎসব আনে সিআরবি। হাসপাতালের মত মহৎ উদ্যোগ শতভাগ জনমতে হওয়া উচিত। চট্টগ্রামে হাজারটা হাসপাতাল একটু সদিচ্ছায় তৈরি করা সম্ভব! কিন্তু সিআরবি আর একটা তৈরি করা সম্ভব না।












