সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সংগ্রামে চট্টগ্রাম সবসময় অগ্রগামী

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ বুধবার ছিল চট্টগ্রামের ইতিহহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম একাডেমির ২৪ তম সাধারণ সভা। প্রতিষ্ঠানটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২০২৫ এ ২৫ বছরে পদার্পণ করেছে। আজ হতে ২৫ বছর পূর্বে চট্টগ্রামের গুটি কয়েক তরুণ; তারুণ্যের উদ্দীপনা নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’। যা আজ বাংলা ভাষাভাষি সকলের নিকট প্রসংশিত ও আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিচিতি পেয়েছে।

নতুন বছর ২০২৫ কে স্বাগতম। ২০২৪ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। সাথে সাথে গত হয়েছে অনেক কিছু জাতিগত বিচ্ছেদ, অনেক কিছু হারিয়েছি। অর্জনও অনেক। সকল হতাশা এবং হারানোর ব্যাকুলতাকে পিছনে ফেলে নতুন চেতনায়, নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০২৫।

চট্টগ্রাম একটি নাম, একটি ইতিহাস। এ চট্টগ্রামে জন্ম নিয়ে খ্যাত হয়েছেন অনেক ইতিহাস বিখ্যাত ও কিংবদন্তিসম ব্যক্তিবর্গ। ‘মদিনাতুল আকছার’ চির সবুজ বন্দর বা ‘মকজানউলআছউইয়ার’ অর্থাৎ সবুজ নগরী বলে খ্যাত এ চট্টগ্রাম। প্রাচ্যের রানি খ্যাত পাহাড়, সমুদ্র উপত্যাকা অরণ্য প্রভৃতি নৈসর্গিক বৈশিষ্ট নিয়ে এ জেলা পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক লীলা নিকেতনে। স্মরণাতীতকাল হতে এর অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ বহির্বিশ্বের মানুষকে এখানে বসতি স্থাপনে আকৃষ্ট করেছে। ১৬৬৬ সালে মোগলরা আরাকানদের হটিয়ে বিস্তর এলাকা দখল করে এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ।

১৭৬০ সালে ইংরেজরা মীর কাশেম আলী খানের কাছ থেকে বিস্তর এলাকা অধিগ্রহণ করে নাম রাখেন চিটাগাং বা চট্টগ্রাম। যা চাটিগাঁও বা চাটগাঁও নামেও সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পরিসরে পর্যালোচনা করা খুবই কঠিন। কবির ভাষায় বলতে গেলে চট্টগ্রামের একটি সুন্দর কবিতা আমাদের সামনে ভেসে উঠে।

‘কি সুন্দর স্থান হয় চট্টল নগর

যার তুল্য নাহি আর জগত ভিতর,

পাদদেশে কর্ণফুলী কল্‌ কল্‌ স্বরে

বয়ে যায়, কি সুন্দর! মিলিতে সাগরে।

উত্তাল তরংগ মালা হেরিয়ে মানব

বিস্মিয়ে ভাবিছে কিবা অগাধ অর্ণব

ঝটিকা সময়ে হয় তরংগ ভীষণ।

হেরিয়ে মানবকুল, ভয়ে ভীত মন’।

মহাকবি নবীনচন্দ্র সেনের দৃষ্টিতে এ ছিল সেকালের চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক রূপ। প্রকৃতি যেভাবে সকল রূপ সুধা ঢেলে চট্টগ্রামকে সাজিয়েছে তেমনি সকল কিছুতেই ইতিহাস সৃষ্টি করে জনকের বা জাতির পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে পথহারা, নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছে এ চট্টগ্রাম। বাংলার ইতিহাসে প্রতিটি ঘটনা, আন্দোলন, সংগ্রামের সূত্রপাত এ চট্টগ্রাম হতে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও সিপাহী বিদ্রোহের অগ্রসেনানী হাবিলদার রজব আলী চট্টগ্রাম থেকেই প্রথম বিদ্রোহের ডাক দেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রথম স্বতস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়। ভাষার লড়াইয়ে আন্দোলনে একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ চট্টগ্রাম থেকে রচিত ও প্রকাশিত হয়।

বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ম্যাগনাকাটা ৬ দফা আন্দোলনের ডাক ঘোষণা এ চট্টগ্রাম হতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে চট্টগ্রাম। স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা চট্টগ্রাম হতেই দেয়া হয়। ফলে মহাত্মা গান্ধীর ‘চট্টগ্রাম সবার অগ্রে’ এ কথাটি বারবার প্রমাণিত হতো। এভাবেই চট্টগ্রাম সর্বদা পুরো জাতিকে যেভাবে সর্বাগ্রে পথ দেখিয়েছে তেমনি চট্টগ্রামের আলোকজ্জ্বল ব্যক্তিত্বরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বসভাকে আলোকিত করে চট্টগ্রামকে করেছে মহিমান্বিত। চট্টগ্রামের সাফল্যের এ ধারাবাহিকতায় তারুণ্যে ভরপুর উৎসাহী উদ্যামী কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠক ও লেখকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ নামক একটি সংগঠন যা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন একটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রকাশ, প্রচার ও গবেষণার মাধ্যমে তা সংরক্ষণের উদ্দেশে ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ ১ জানুয়ারী ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যেন বিংশ শতাব্দীর নতুন সময়ের সূর্য ওঠার সাথে সাথে নতুন চিন্তা জাগরণের শুভ সংবাদ। জাতিকে নতুন কিছু দেয়া এবং নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যেই শুরু হয় এর পদযাত্রা। আত্মপ্রকাশের শুরু হতে এ সংগঠন চট্টগ্রামের লেখক ও প্রকাশনা শিল্পের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং চট্টগ্রামে লেখক, কবি, সাহিত্যিক সৃষ্টির গুরুদায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম হতে প্রথম ‘স্বাধীনতার বইমেলা’ নামক বইমেলার আয়োজন শুরু করে। দেশের যুব সমাজকে অপসংস্কৃতির বেড়াজাল হতে মুক্ত করে দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত করা, তাদের ভিতর দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য চট্টগ্রাম একাডেমি কাজ করে। ইতিহাস শেখা ও জানানো এবং শিকড়ের সন্ধান ব্যতিত কোন জাতি সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে না।

মানুষকে বইমুখী তথা বইপ্রেমী করার জন্য এবং চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক সকলকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমধর্মী বইমেলার আয়োজন শুরু করে চট্টগ্রাম একাডেমি।

স্বাধীনতার বইমেলা’ নামে এ বইমেলা চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যতিক্রমধর্মী বইমেলা হিসেবে সর্বমহলে প্রসংশিত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দীর্ঘ ১৮টি বছর এই বইমেলা ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে একক বইমেলা আয়োজনের পর থেকে চট্টগ্রাম একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত এই বইমেলার কার্যক্রম বইমেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন সাংগঠনিক, সাংস্কৃতিক, সেমিনার, শিশুমেলা, ছড়া সম্মেলন সহ নানারকম বর্ণাঢ্য প্রভৃতি আয়োজনের মাধ্যমে তাদের কার্য্যক্রম চালু রাখে। চট্টগ্রাম একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত এসব বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছেন দেশবিদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাহিত্যিক, কবি, ছড়াকার, শিক্ষাবিদ হতে শুরু করে বাংলা ভাষাভাষির সকল অঞ্চলের কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণে চট্টগ্রাম হয়েছে সমৃদ্ধ।

চট্টগ্রাম একাডেমির ২৫ বছর উদযাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে পুরো বছর নতুন নতুন কার্যক্রমে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা আমাদের। বিগত সময়ে চট্টগ্রাম একাডেমির অনুষ্ঠানমালায় যেসব ঐতিহাসিক আলোকিত ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন সমৃদ্ধ হয়েছে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবার আশা রাখি। আমরা আশা রাখি ২০২৫ এ নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে পরিণত করে এবং যৌথ শিল্পায়ন সাধন ও যৌথ অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারবে।

পরিশেষে সব কুসংস্কার অন্ধকার আর অপশক্তির বাধ্য জয় করে নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাবে এটাই আজ আমাদের সকলের প্রত্যাশা। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এমন চাওয়া বাংলার প্রতিটি মানুষের। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম একাডেমি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এ প্রত্যাশা করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসরকার পরিবর্তন ও মানসিকতার পরিবর্তন
পরবর্তী নিবন্ধ‘আদর্শ জীবন হচ্ছে ভালো বন্ধু, ভালো বই আর ঘুমন্ত বিবেক’