সাহিত্যে নতুন মাত্রা সঞ্চার করেন চৌধুরী জহুরুল হক

স্মরণসন্ধ্যায় আজাদী সম্পাদক

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে চৌধুরী জহুরুল হক একজন নিরীক্ষাধর্মী সৃজনশীল শিল্পস্রষ্টা। একাধারে তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, গল্পকার, গীতিকার, রসসাহিত্য স্রষ্টা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল চিন্তা, গবেষণা ও সম্পাদনার কাজও করেছেন প্রচুর। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, মেধা-মনন ও নতুন উদ্ভাবনী কৌশল দিয়ে সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা সঞ্চার করেন তিনি।

নাট্যকার চৌধুরীর জহুরুল হক স্মরণসন্ধ্যা-২০২৩ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। নাট্যমঞ্চ চট্টগ্রামের উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে এ স্মরণসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্মারক বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। নাট্যমঞ্চ সম্পাদক জাহেদুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয় অভিনেত্রী শিপ্রা চৌধুরী এবং নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ম. সাইফুল আলম চৌধুরীকে। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব রবিউল আলম ও নাট্যকার অভীক ওসমান। সঞ্চালনা করেন বাচিক শিল্পী দিলরুবা খানম।

এম এ মালেক বলেন, শিক্ষক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ জহুরুল হক সাহিত্যের প্রতিও ছিলেন প্রবল অনুরাগী। তাই শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চা দুটোই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন। সাহিত্যে তার অন্যতম ব্যতিক্রমী সৃষ্টি ‘চোঙ্গা গল্প’। এটি মূলত রম্যরচনা। এ ধরনের গল্পগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে এবং সাহিত্যে এই নতুন ধারাটি একটি আন্দোলনে রূপ নেয়। নাট্যজগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

তিনি বলেন, মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক একুশের প্রথম কবিতার পূর্ণাঙ্গ মূল পাঠ উদ্ধারের কৃতিত্ব চৌধুরী জহুরুল হকের। লুপ্তপ্রায় এই পাঠের ওপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা’। এটা প্রকাশ করে কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস।

এম এ মালেক বলেন, চৌধুরী জহুরুল হক চারিত্রিক এবং চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তার নামের মধ্যে সে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। সাধারণত মানুষের নামের শেষে চৌধুরী থাকে। আমার মনে হয় তাঁর বাবা নাম রেখেছেন জহুরুল হক চৌধুরী। হয়তো ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার সময় তিনি চৌধুরী আগে নিয়ে এসেছেন। এখান থেকেই বোঝা যায় তার জীবনধারা ব্যতিক্রম ছিল।

‘চট্টগ্রামে নাট্যচর্চা : পরিপ্রেক্ষিত অতীত ও বর্তমান’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই চট্টগ্রামে আঞ্চলিক নাটকগুলো বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। গ্রামীণ ও শহরের জনগোষ্ঠী উভয়ের কাছে প্রিয় নাটকে চট্টগ্রামের জনজীবন-সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর ধারার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক আবদুল গফুর হালির ‘গুলবাহার’ ও ‘সতী মাইমুনা’, এমএন আখতারের ‘চুড়িওয়ালা’, সনজিত আচার্যের ‘সাম্পানওয়ালা’ ও ‘সোনাইবন্ধু’, আইয়ুব রানার ‘দুবাইওয়ালা’র উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বর্তমানে এ ধারার নাটক বিলুপ্তপ্রায়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতো চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকেও ব্যাপক জোয়ার পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকের বৃহৎ অংশজুড়ে প্রতিফলিত হয়েছে সমসাময়িক সমাজজীবনের নানা সংকট, ব্যক্তির যাপিত জীবনের যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ সংগ্রামী মানুষের জীবন ও জীবন-সংগ্রাম।

সেই সাথে নিজস্ব জনপদের সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিতও উঠে এসেছে মঞ্চের মুকুরে। চট্টগ্রামের জনজীবন, সংস্কৃতি ও লোকজীবনের অনুষঙ্গ মঞ্চনাটকের ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে। চট্টগ্রামের লোককথা, পুঁথি, পালা এবং এ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ ও মানুষের জীবন সংগ্রামকে নাট্যমঞ্চে তুলে আনার এ প্রচেষ্টা মূলত নিজের কাছে ফিরে আসারই অভিপ্সা।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে মঞ্চস্থ বেশ কিছু নাটকের পটভূমিতে প্রস্ফুটিত হয়েছে চট্টগ্রামের লোকজজীবন। চট্টগ্রামের জনজীবন ও লোকাচার অবলম্বন করে রচিত ও মঞ্চস্থ নাটকগুলো এ জনপদেরই প্রতিচ্ছবি। নিজস্ব সংস্কৃতির লালন-বিকাশ-প্রচারে নাটকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় চট্টগ্রাম স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ঢাকার পর ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে বেশ কিছু নাট্যদল গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু করে। চট্টগ্রামে এখন প্রায় ৩০টি নাট্যদল আছে, যার মধ্যে অধিকাংশই সক্রিয়।

সম্মাননা স্মারক পাওয়া নাট্যকার ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের ওপর বক্তব্য রাখেন নাট্যচিন্তক অভীক ওসমান। তিনি বলেন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ম. সাইফুল আলম। জুলিয়াস-সিজারের অনুবাদক তিনি। বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। অনুবাদ নাট্যসাহিত্যে অবদান আছে তাঁর।

সম্মাননা স্মারক পাওয়া অভিনেত্রী শিপ্রা চৌধুরীর ওপর বক্তব্য রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব রবিউল আলম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে একসময় ‘অফিসপাড়া’ নাটকের প্রচলন ছিল। মুসলিম হলে প্রদর্শিত হতো। সেই নাটকের একচ্ছত্র রাণী ছিলেন শিপ্রা চৌধুরী।

অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, যতটা না শিক্ষক তার চেয়ে বেশি বন্ধুসুলভ ছিলেন চৌধুরী জহুরুল হক। তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন।

শিপ্রা চৌধুরী বলেন, মা-বাবা উৎসাহ দিতেন, তারা চাইতেন আমি যেন নাটকে প্রতিষ্ঠিত হই।

জাহেদুল আলম বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নাটককে সমৃদ্ধ করেছেন চৌধুরী জহুরুল হক। চট্টগ্রামেই প্রথম কাব্যনাট্য রচিত হয়। সেটা চৌধুরী জহুরুল হক গবেষণা করে প্রমাণ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে সমাজসেবা দিবস পালিত
পরবর্তী নিবন্ধগর্তে পড়া দেশকে টেনে তুলতেই বিএনপির ১০ দফা : খসরু