সাহিত্যব্যক্তিত্ব অরুণ দাশগুপ্তের চির বিদায়

| রবিবার , ১১ জুলাই, ২০২১ at ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দেশের বর্ষীয়ান সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত আর নেই। তিনি গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে নিজ বাড়িতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণে দৈনিক আজাদী পরিবারের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করছি।
অরুণ দাশগুপ্ত কেবল সাংবাদিক নন, তিনি একজন নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিক, মেধাবী গবেষক, বিরলপ্রজ কবি ও গুণী সাহিত্য সম্পাদক। জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে অভিজ্ঞতায় একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল ও মননশীল জগতের একজন অনুকরণীয় পুরুষ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য- এমন কোনো দিক নেই যে তিনি জানেন না। সব বিষয়ে সমান অবগত ও আগ্রহ। অল্প কয়েক দিন আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৮৫ বছর বয়সেও তিনি তাঁর কর্মে সক্রিয় ও লেখালেখিতে নিবেদিত ছিলেন। দৈনিক আজাদীতে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে গত মাসেও তাঁর দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। এছাড়া সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুদীর্ঘকাল। কয়েক বছর আগে ২০১৫ সালে, কাগজে-পত্রে অবসরে গেলেও আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেক তাঁকে ধরে রেখেছেন নিজের কাজের সঙ্গে, সর্বোপরি আজাদীর সঙ্গে।
অরুণ দাশগুপ্ত ১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি পটিয়ার ধলঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। ধলঘাটের পাঠশালায় হাতেখড়ি তাঁর। তারপর চলে যান কলকাতায়। সেখানে কালাধন ইনস্টিটিউশন, সাউদার্ন থেকে মাধ্যমিক এবং স্কটিশচার্চ কলেজ কলকাতা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তারপর বিশ্বভারতী লোক শিক্ষা সংসদ। কলকাতার দৈনিক লোকসেবক পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা- জীবন শুরু তাঁর। এর পর চলে আসেন দেশে। স্বাধীনতার পর কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে যুক্ত হন সহ সম্পাদক পদে। তখন থেকেই সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের লেখকরা তাঁর কাছে ঋণী। তবে যেভাবে তিনি লেখালেখি করেছেন, লেখক-বয়স দীর্ঘ হলেও তাঁর বইয়ের সংখ্যা খুবই কম, যা তাঁর অনুরাগীদের পীড়ার কারণ। তিনি সৃষ্টিতে যেমন উদারহস্ত, কিন্তু বই প্রকাশে ছিলেন ততটা অনাগ্রহী। মাত্র দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সেগুলো হলো, ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ এবং ‘যুগপথিক কবি নবীন চন্দ্র সেন’।
অরুণ দাশগুপ্তের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ গ্রন্থটির ভূমিকায় শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও কবিতা সীমাহীন সুন্দর। সুর বাণীতে এবং বাণী সুরে মিলেমিশে আমাদের দু’চোখে দেখা বিভিন্ন ঋতুর দিনগুলো অন্তরের চোখে ও কানে অপরূপ রূপে ও মাধুর্যে মূর্ত হয়েছে তাঁর গানে; কীভাবে, তা’ই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত তাঁর এই ঋদ্ধ গ্রন্থে।’
অরুণ দাশগুপ্ত নিজে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির মূল্যাতীত সম্পদ। অনন্য সংগীতস্রষ্টা তিনি। রবীন্দ্রনাথের তুল্য কম্পোজার পৃথিবীর সংগীতের ইতিহাসে বিরল। সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি বিটোফেন ভাগনার, মোজার্ট, সেবাস্টিয়ান বাখ, হান্ডেল, চাইকফস্কির সঙ্গে তুলনীয় হলেও সংগীতের নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রকে ব্যক্তিক করেছেন তিনি। সংগীতের বিমূর্ততাকে মূর্ত করা ও সুরের মানবায়ন ঘটানোতে তাঁর তুল্য কোনো সংগীতস্রষ্টা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। রবীন্দ্রনাথ অত্যুৎকৃষ্ট সুর ও অত্যুৎকৃষ্ট কবিতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো সংগীতের মানবায়ন আর কেউ ঘটাতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গানগুলোর দিকে নজর দিলে আমরা সেটা অনেকটা বুঝতে পারি। গানের বাণী ও সুরের এমন যুগল সম্মিলন রীতিমত বিস্ময়কর।’
এই প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি আমাদের প্রকাশনা ও প্রবন্ধসাহিত্য অঙ্গনে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। এর বাইরে তাঁর অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে মূল পরিচয় হলো তিনি কবি। অজস্র কবিতা লেখা হলেও কবিতার কোনো বই বের হয় নি তাঁর। যদিও তাঁর কবিতা অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। আত্মগত ভাবনা আর অন্তর্গত বেদনার ছায়াচিত্র তাঁর কবিতার অবয়বে ধরা দিয়েছে। সাধু ভাষায় রচিত হয়েছে তাঁর অনেকগুলো কবিতা। বলা যায়, প্রচলিত নিয়মরীতিকে উপেক্ষা করে তিনি আলাদা এবং নিজস্ব প্রকরণ রীতির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেছেন কবিতার ভুবন। বিষয় বৈচিত্র্য আর বিচিত্র ভাবনার সৃজনশক্তিতে তিনি সপ্রাণ।
অরুণ দাশগুপ্তের মৃত্যুতে আমাদের সংবাদপত্র ও সাহিত্যাঙ্গনে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা অপূরণীয়। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে