সাহাবায়ে কিরাম: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত্রের মূর্ত প্রতীক

মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম | মঙ্গলবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি পরম করুণাময়। সালাম ও বরকত বর্ষিত হোক আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।

ইসলামের ইতিহাসে সাহাবায়ে কিরাম এমন এক অনন্য প্রজন্ম, যাদের জীবন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র, আদর্শ ও শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিফলন। তাঁরা কেবল কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নন, বরং তাঁরা মানবতার সেই উজ্জ্বল দল, যাদের জীবনে নবীজির ছায়া সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখানো যায়। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তাঁদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করেছে, চরিত্রকে উজ্জ্বল আলোয় পরিণত করেছেন। এবং তাঁরা নিজেদেরকে পুরো মানবজাতির সামনে পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত গ্রহণের ফলে যে নির্যাতননিপীড়নের সম্মুখীন তাঁরা হয়েছিলেন, তা ছিল অমানবিক ও নির্মম, তবুও তাঁরা সত্যকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। তাঁদের এ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্মরণ করতে গেলে সুমাইয়া (রাঃ) এবং ইয়াসির (রাঃ) এর ত্যাগের কথা প্রথমে স্মরণ করতে হয়। যারা ছিলেন ইসলামের প্রথম দিকে নির্যাতিত সাহাবিদের প্রথম শহীদ দম্পতি। সামাজিকভাবে দুর্বল হলেও তাওহীদের পথে তাঁদের দৃঢ়তা ছিল অবিচল। মক্কার মুশরিকরা তাঁদেরকে উত্তপ্ত মরুভূমির বালিতে টেনে নিয়ে যেত, শরীরে শিকল চাপিয়ে যন্ত্রণা দিত, তবুও তাঁরা বলতেন ‘আহাদ! আহাদ!’। আল্লাহর একত্ববাদে তাদের বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে নির্যাতনের শেষ মুহূর্তেও তাঁরা সত্য ত্যাগ করেননি। সুমাইয়া (রাঃ) অত্যাচারের শিকার হয়ে ইসলামের প্রথম নারী শহীদ হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, আর কিছুদিন পর তাঁর স্বামী ইয়াসির (রাঃ)-ও শহীদ হন। তাঁদের এই ত্যাগ প্রমাণ করে নবীজির দাওয়াত কীভাবে সেসব আলোকিত মানুষগুলোর অন্তরকে জাগ্রত করে তুলেছিল এবং তাঁদের হৃদয়ে ঈমানের আলো প্রজ্বলিত হয়েছিল।

এ ত্যাগের ধারাবাহিতায় ইতিহাসে আরেক উজ্জ্বল নাম হযরত বিলাল (রাঃ)। তিনি ছিলেন একজন দাস, কিন্তু ঈমানের মর্যাদায় ছিলেন আকাশের তারার চেয়েও উঁচু। উমাইয়া ইবন খালাফ তাঁকে উত্তপ্ত বালিতে শুইয়ে বর্ম পরিয়ে সূর্যের নিচে পুড়ত, আর তার বুকের ওপর বড় পাথর চেপে ধরত তবুও তাঁর ঠোঁট উচ্চারণ করত ‘আহাদ আহাদ!’ অর্থাৎ এক আল্লাহ, এক আল্লাহ। দাসত্বের শিকল তাঁর দেহকে বন্দী করতে পেরেছিল, কিন্তু তাঁর ঈমানকে নয়। তাঁর অবিচল তাওহীদ নবীজির হৃদয়েও বিশেষ স্থান লাভ করেছিল। নবীজি তাঁর কণ্ঠকে বেছে নেন প্রথম আজানের জন্য এ যেন আল্লাহর কুদরত যে কণ্ঠ একসময় নির্যাতিত ছিল, সেই কণ্ঠেই পৃথিবীতে প্রথমবার প্রতিধ্বনিত হলো: ‘আল্লাহু আকবার!’ হযরত বিলাল (রাঃ)-এর এই ত্যাগ প্রমাণ করে, ঈমান সঠিক হলে দুনিয়ার কোনো অত্যাচার মানুষকে ভেঙে দিতে পারে না।

সাহাবিদের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে হলে নবীজির প্রশংসা স্মরণ করতে হয়। যেমন আবু বকর (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন ‘মানুষের মধ্যে ঈমানের দিক থেকে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহশীল ব্যক্তি আবু বকর।’ (সহীহ বুখারি ৩৬৬১)। এটি প্রমাণ করে আবু বকর (রাঃ)-এর সততা, ত্যাগ, নম্রতা, এবং ঈমান নবীজির কাছে কতটা প্রিয় ছিল। তিনি নিজের সম্পদ, জীবন, সম্মান সবই নবীজির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। হিজরতের রাতে নবীজিকে রক্ষা করতে তিনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর ব্যাপারে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘উমর কোনো পথ ধরে হাঁটলে শয়তান অন্য পথ ধরে পালিয়ে যায়।’ (বুখারি ৩৬৮৩; মুসলিম ২৩৯৬)। উমরের ঈমান, ন্যায়পরায়ণতা, দৃঢ়তা, দায়িত্ববোধ সবই ছিল রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশিক্ষণের শক্ত ছাপ। তাঁর শাসনামলে ন্যায়বিচার এমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে একটি দুর্বল মানুষও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারত এবং তিনি নিজেই আদালতে হাজির হতেন। এমন ন্যায় আজও পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় না।

উসমান (রাঃ) ছিলেন লজ্জাশীলতা ও পবিত্রতার প্রতীক। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাঁর সম্পর্কে বলেন ‘আল্লাহ কি এমন ব্যক্তির প্রতি লজ্জাশীলতা পছন্দ করেন না যাঁর প্রতি আমিও লজ্জাশীল?’ (সহীহ মুসলিম ২৪০১) এবং আরেক হাদিসে ঘোষণা করেন ‘উসমানের জন্য আছে জান্নাত।’ (বুখারি ৩৬৯৩)। তাঁর উদারতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে রোমা কূপ ক্রয় করে উম্মতের জন্য দান করেছিলেন এবং তাবুক অভিযানে বিপুল সম্পদ দিয়ে ইসলামের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলেন।

আলী ইবনু আবি তালিব (রাঃ) ছিলেন জ্ঞান, সাহস, বিচারবুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন ‘আমি যার মাওলা, আলী তার মাওলা।’ (তিরমিযি ৩৭১৩, হাসান সহীহ)। আরেক হাদিসে তাঁকে সম্বোধন করে বলেন ‘তুমি কি খুশি নও যে আমার কাছে তোমার অবস্থান হারুনের অবস্থানের মতো?” (মুসলিম ২৪০৪)। তাঁর জ্ঞান, বীরত্ব ও নেতৃত্ব ছিল নবীজির নিকটতম সান্নিধ্যের প্রতিফলন, যা তাঁকে উম্মতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সকল সাহাবীর সম্মিলিত মর্যাদা সম্পর্কে রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে সতর্ক করে বলেছেন ‘আমার সাহাবিদের গালি দিও না। যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ! তোমরা কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করলেও তাদের একজনের অর্ধ মুদ দানের সমান হতে পারবে না।’ (সহীহ বুখারি ৩৬৭৩; মুসলিম ২৫৪০)। এই হাদিস প্রমাণ করে সাহাবিদের সামান্যতম আমল, সামান্যতম দানও এমন মর্যাদা বহন করে, যা মানব ইতিহাসে অনন্য। তাঁদের আমল ছিল নবীজির সান্নিধ্যে অর্জিত আন্তরিকতা ও ত্যাগের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা সাধারণ মানুষের আমলের সঙ্গে তুলনীয় নয়।

সাহাবিদের জীবনের প্রতিটি দিকেই ছিল নবীজির আদর্শের সরাসরি প্রতিফলন। তাঁরা সত্য ধরে রেখেছেন, মানুষের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন, শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, গরিবের পাশে দাঁড়িয়েছেন, রাতভর ইবাদত করেছেন, রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য জীবন বিলিয়েছেন এবং তাঁর দাওয়াত পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁদের জীবন প্রমাণ করে একটি আদর্শ সমাজ, ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা এবং উন্নত মানবিক চরিত্র গড়ে তুলতে নবীর শিক্ষা যথেষ্ট।

আজকের নৈতিক অবক্ষয় ও অস্থিরতার যুগে সাহাবিদের জীবনই আমাদের সামনে সবচেয়ে শক্তিশালী দৃষ্টান্ত। তাঁদের মতো অভিন্নতা, সত্যবাদিতা, দায়িত্ববোধ, দয়া, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ সবই নূর নবীর আলোয় আলোকিত হতে পারে। সাহাবিদের জীবন বলে দেয় যারা সত্যের পথে অটল থাকে, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদার শীর্ষে উন্নীত করেন।

রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলো বহন করার সর্বোত্তম পথ ছিল সাহাবাদের জীবন;

আর সেই পথ আজও খোলা

যারা আন্তরিকতায় হাঁটতে চায়,

তাদের জন্য আকাশের তারা এখনো নির্দেশ করে রসুলের পথ।

এসো, তাদের তাকওয়া, ত্যাগ, ভালোবাসা ও নৈতিকতার স্পর্শে

আমরাও আমাদের হৃদয়ে নববীর আলো জ্বালাই।

কারণ যে আলোর পথে সাহাবারা হেঁটেছেন

সেই পথেই আছে দুনিয়ার শান্তি,

আর আখিরাতে চিরস্থায়ী মুক্তির সুবাস।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্ত দিয়ে এনেছি বিজয়
পরবর্তী নিবন্ধজাহাজ ভাঙা শিল্প রক্ষায় স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি