সাহস ও সততার পদ্মা সেতু স্বপ্নসারথি শেখ হাসিনা

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | শনিবার , ২৫ জুন, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

গত ১ জুন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন, “নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু করে ফেলার মধ্য দিয়ে সততার শক্তি প্রমাণিত হয়েছে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ আত্মমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার প্রধানের চরিত্র্য-বৈশিষ্ট্য তথা স্বচ্ছতা ও আন্তঃসত্য প্রতিফলিত হয়েছে। কেননা পদ্মা সেতু এখন কেবল একটি অবকাঠামো বা স্থাপনা নয়, জাতির প্রাণশক্তি ও দৃঢ়তার প্রতীক। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন জাতীয় সামর্থ্যেরও দৃষ্টান্ত। দেশী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুর মত মেগাপ্রকল্প যখন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পথে, তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ়তর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে। তাদের অর্থায়ন ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজস্ব টাকায় যোগাযোগের এই বৈপ্লবিক যুগের সূচনা তথা পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। আজ ২৫ জুন যেটির বর্ণাঢ্য উদ্বোধন এবং সারা বাংলাদেশে সেটি উদযাপিত হবে।

বর্তমান বাস্তবতায় ‘কানেকটিভিটি’ বা যোগাযোগ উন্নয়নের একটি মৌলিক সূচক। এ কারণে এখন বিশ্বের কোনো স্থান অবহেলিত, দুর্গম, বঞ্চিত বা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে পারে না এবং তা অগ্রগামিতার সমার্থকও নয়। এর প্রেক্ষাপটে সমগ্র দুনিয়া এখন সমান তাৎপর্যবাহী ও মনোযোগপ্রাপ্ত। এখন প্রান্ত ও কেন্দ্র একাকার। তাই ‘বিশ্বগ্রাম’ পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে সামিল হলো।

মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করা। যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নয়, একটি পরিকল্পিত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে এক করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। আজ সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।
নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলা ও বাঙালির গৌরবের প্রতীক। ১৯৯৮ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে যে স্বপ্নের শুরু তা আজ বাস্তবতা। শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের সোনালি ফসল পদ্মা সেতু। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগের পথ উন্মুক্ত হলো। এই সেতু চালুর পর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজধানী ঢাকা ও সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফ লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করা ছাড়াও পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গ্রথিত করবে এই সেতু। পদ্মা সেতু ঢাকা থেকে মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-পায়রা-কুয়াকাটা-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত সুবিসৃ্তত ইকোনমিক করিডোর গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করবে। পদ্মা সেতু যেমন প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে, তেমনি সহজ হবে যান চলাচলও। বহুল প্রত্যাশিত এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দূরত্ব কমাবে ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। সরাসরি উপকৃত হবে তিন কোটির বেশি মানুষ। দারিদ্র্য কমাবে এক দশমিক নয় শতাংশ হারে। বলা যায়, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু উদ্বোধন হবে আজ ২৫ জুন। এই দিনটি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ইতিহাসে অগ্রগতির স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হবে ভাবীকালে। এই পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতাও উল্লেখযোগ্য। দেশীয় কুচক্রীদের চাপে পড়ে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে যে, দুর্নীতির সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা।

সেতুর প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। যা দেশের মোট বাজেটের ৮৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

সেতুর স্টিলের স্প্যানের উপর দিয়ে চলবে যানবাহন। এই পথ তৈরির জন্য বসানো হয়েছে কংক্রিটের স্ল্যাব। তারপর পিচ ঢালাই করা হয়েছে। চলাচলের পথটি ২২ মিটার চওড়া চার লেনের। মাঝখানে বিভাজক। সেতুতে আছে একটি রেললাইন। স্প্যানের ভিতর দিয়ে চলবে ট্রেন। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। ভায়াডাক্টে এসে যানবাহন ও ট্রেনের পথ হবে আলাদা।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার ১ম, এশিয়ার ১১তম, বিশ্বে ১২২ তম সেতু। এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শেখ হাসিনা বিশ্বের কাছে এই বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন যে, আমরাও পারি। শুধু পরমুখাপেক্ষি, ঋণ বা অনুদাননির্ভর প্রকল্প নয়, নিজেদের অর্থায়নে নিজেদের সামর্থ্যেও যে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব, পদ্মা সেতু তারই জ্বলজ্যান্ত নমুনা।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যক্তিত্ব, চরিত্র্য, স্বচ্ছতা, দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়নের অগ্রযাত্রাবাহী সরকার এর প্রমাণ সুস্পষ্ট। এসেতু দেশের জন্য নানাবিধ সুফল বয়ে আনবে। এই সেতুর দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রাও বদলে যাবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বৃহৎ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেতু সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সেতুর দুই পাশে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই শহরের আদলে পরিকল্পিতভাবে নতুন শহর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এর সঙ্গে আবাসিক সুবিধার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি হবে শিল্পকারখানা। যার মাধ্যমে প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর বিনিয়োগের ১৯ ভাগ রিটার্ন আসবে প্রতিবছর। এছাড়া পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় পরিবহন সেক্টরে বিনিয়োগ হবে অন্তত ২০০ কোটি টাকা। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে ২১ জেলা জুড়ে। বাড়বে কৃষিজ উৎপাদন। সহজ হবে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। মানুষের আয় বাড়বে। কৃষি খাতেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। কেবল পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প নয়, শেখ হাসিনার সরকার বাস্তবায়ন করছে আরো অনেক মেগা- প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি। এ সমস্ত বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ আগামীতে সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মান।

বর্তমান সরকার আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এশিয়ার পঞ্চম টাইগারে পরিণত হবে- এ শুধু কথার কথা নয়, বাংলাদেশ এখন সকল সূচকেই এশিয়ার অন্যতম অগ্রসর এক রাষ্ট্র। মানুষের জীবন-মান, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও প্রসূতি মাতৃ-মৃত্যু হার কমিয়ে আনা ইত্যাদি নানা সূচকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা, সুশাসন এবং মনোবল ও দৃঢ়তার কারণেই বাংলাদেশের এই অর্জন। এক অর্থে বলা যায়- পদ্মা সেতু মানে পুরো জাতির আত্মবিশ্বাস ও অনমনীয়তার বহিঃপ্রকাশ। ইস্পাতকঠিন নেতৃত্বে নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা ‘রূপকল্প-৪১’ বাস্তবায়নে হাজারো বাধার বিন্ধ্যাচল ও ষড়যন্ত্র ধুলিসাৎ করে এগিয়ে যাবেন- এই আশা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারি।

১৯৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর আম্‌্রকাননে সিরাজের পরাজয়ের যে গ্লানি সেটি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ নয় বরং ১৯৭১ সালের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে মোচন হেয়েছে। আর বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিশ্বের সম্মুখে আরো একবার মর্যাদার আসনে সমাসীন হলো।

লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, সভাপতি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধশেখ হাসিনার পদ্মা সেতু আস্থার অক্ষয় জ্যোতি