ক্ষেত্রমনির হাহাকার
গত শতাব্দীর ৯০ দশকে সূচনালগ্নে আন্দরকিল্লা মোড়ে ‘চৌরঙ্গী সংস্কৃতি পরিবার (১৯৮২–১৯৮৪)’ নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। আমরা একটু ব্যতিক্রমধর্মী কৃষ্টির চর্চা শুরু করেছিলাম। সাধারণ সম্পাদকের নাম ছিল ‘সচেতক’ (স্পিকার)। চিঠিতে এড্রেস করতাম ‘প্রিয় সুন্দর’। ১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে ওয়াহ্দাদারেনকো ও ব্যান্ডবক্সের বারান্দা দুটোকে নিয়ে গানের দল, ধারা বর্ণনা, নাট্যাংশ অভিনয় এভাবে থ্রি ডাইমেনশন স্টেজ করে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। সেই তরুণ সন্ধ্যায় নীলকর রোগ সাহেব (অনুপ মিত্র), ক্ষেত্রমনি নির্যাতনের নাট্যাংশ পাঠ করেছিল সালমা চৌধুরী (ক্ষেত্রমনি)। তরুণ বয়সে আমি বিস্ময়ে লক্ষ্য করি নগরীর এলিট লেডি ট্রাইবাল টাইপ খোঁপাপাড়া সালমা চৌধুরী কি করুণভাবে আর্তনাদ ছড়িয়ে দিয়েছিল নগরীর আন্দরকিল্লা অন্ধকারে। উক্ত অনুষ্ঠানে নীল দর্পণ থেকে জল্লাদের দরবার পর্যন্ত নাটকের অংশবিশেষ পাঠ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে মমতাজ সবুর স্মারক প্রদান অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম, সালমা চৌধুরী ও ফাহমিদা আমিন এদের সম্মান ও মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা পেশ করেছিলেন।
সালমা আহমেদ এ নামেও আমি তাকে চিনতাম। মূলত ১৯৭৬–৭৭ দিকে আমি চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা সংসদের জিএস,ভিপি ছিলাম। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মমতাজ উদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলা সংসদ সেমিনার ও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করত। তখন আচার্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক অতিথি বক্তা হয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামনে বক্তৃতা করলেন। বলা যায়, ক্লাসই নিলেন। যথারীতি তাকে বাসায় ফিরিয়ে দেয়ার প্রটোকল আমাকে দেয়া হলো। আট আনা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে এ পন্ডিতজনকে আমি সালমা চৌধুরীর বাসায় পৌছে দিই। তখন থেকে এই বাসার সাথে আমার পরিচয়।
রহমতগঞ্জের বাসা
দোতলা বাসার বারান্দায় বহুবার গিয়েছি। একবার দেখা হলো সিনে সাংবাদিক আনিসুল হক গামা, কন্যা হাসিনা আহমদের সাথে। প্রয়াত গীতিকার খোশনুর আলমগীর আপার বন্ধু জেনে স্লাঘা অনুভব করেছিলাম। নাটকের কথা প্রসঙ্গে বলি, মধ্য ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের প্রথম নাট্য সমন্বয় পরিষদে সালমা চৌধুরী ও মাহবুব হাসান লোকালয় নাট্যদলের প্রতিনিধিত্ব করেন। আবু ফজলের সাহিত্য নিকেতনের নিচে ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলামের বাসায় এ কমিটি গঠিত হয়। গণায়ন থেকে আমি ও ডা. মনোতোষ ধর প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলাম। সালমা চৌধুরী মেধাবী তরুণদের খুব পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে আদর করে কাজলরেখা নামে সম্বোধন করতেন। আমার ব্যক্তিগত এক বিষয়ে তৎকালীন ডিসি আবদুল মান্নান (পরবর্তীতে মন্ত্রী) বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘দৃষ্টি’র প্রথম আবৃত্তি ক্লাসে আমাকে দিয়ে বক্তৃতা করান। তরুণদের এমনি সম্মান দিতে পারতেন। সর্বশেষ দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার গ্র্যাজুয়েট ইলেকশনে নমিনেশন ফরম সাইন করার জন্য রাত দেড়টা–দুইটার দিকে মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী সহ তাঁর বাসায় আমি হাজির হয়েছিলাম। তীব্র গরমে তিনি বারান্দায় মশারী টাঙিয়ে শুয়েছিলেন। আমাদের চাপের মুখে তিনি সিগনিচার করেন। সর্বশেষ রোগশয্যায় তাকে দেখতে গেলে তিনি আমাকে কোনো একটি বিষয়ে বলেন ‘ডোন্ট কাম টু মাই হাউজ, এবাউট দ্যা মেটার’। রোগশয্যায়ও এরকম বাঘিনীর মত ক্যারেকটার অত্যন্ত প্রণম্য। এখনও আমি ‘শবে বরাত, শবে কদর মিসকিন শাহর মাজার’ জিয়ারত করে সিড়ি দিয়ে নামতে সালমা চৌধুরীর কবরে কবরগাহের মুখোমুখি হই। রসূল (দরূদ) এইসব পবিত্র রজনীতে জিয়ারত পছন্দ করতেন।
ফাহমিদ আমিন বলছেন, বারাসাত ও রাজশাহী পিএন গার্লস হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সালমা কাজলরেখার রাজপুত্র অভিনয় করেছেন। রক্তকরবী নাটকে নন্দিনী, সোহরাব রুস্তমে তাহমিনা, সাথে ভোলা সেন। লোকালয়ের ‘যদি আমি কিন্তু আমি’, রজনীগন্ধা, মরা মানুষের পাঠশালা, হরিণ চিতা চিল, রাজা অনুস্বারের পালা, চট্টগ্রাম বেতারে শিশুদের প্রোগ্রাম, সুখীজন (এডভোকেট কাউসার পারভীন ও ফেরদৌস আরা আলীম সহযোগে), বিসর্জন নাটকে গুণবতী। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষায় জলপড়ি শাড়িতে নববধূ। গান পদ্য নাটক সবকিছুতে জড়িত ছিলেন।
সংস্কৃতি পরিষদ
নব্বইয়ের স্বৈরশাসনের মধ্য সময় সালমা চৌধুরীর বাসায় ড. মঞ্জুর উল আমিন চৌধুরীসহ আমরা চট্টগ্রাম সংস্কৃতি পরিষদ গড়ে তুলি। এই সংস্কৃতি পরিষদের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ। পরে ড. মনিরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মনিরুজ্জামান তনয়া দোলার মৃত্যুর পর সালমা চৌধুরীকে আমরা প্রেসিডেন্ট করি। এর উপদেশক ছিলেন আবদুল হক চৌধুরী, ওহিদুল আলম, সাবেক প্রধান বিচারপতি ব্যারিস্টার ফজলুল করিম চৌধুরী, এয়াকুব আলী মোল্লা, পটিয়ার শিপিং সেক্টর ব্যক্তিত্ব শামসুল আলম। আমি এর জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলাম। ড. আশরাফ সিদ্দিকী, কবি শাহেদ রহমান সহ অনেক গুণীজন সালমার বাসায় আসতেন। এ আড্ডা পরবর্তীতে মিনতি বিশ্বাসের বাসায় ট্রান্সফার হয়ে যায়।
শিক্ষাবিদ সালমা চৌধুরী
ঢাকার শাহীন স্কুলে, তেজগাঁ পলিটেকনিক গার্লস হাই স্কুলে, চট্টগ্রাম সোসাইটি প্রাইমারী স্কুলে। ছিলেন ইসলামিয়া কলেজে। সবশেষে পাহাড়তলী কলেজে। ছিলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সর্বোচ্চ দায়িত্বে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে কমার্শিয়াল অফিসার পদে তিনি কিছুকাল কাজ করেছিলেন। সেখানকার কর্মজীবনের স্মৃতি মনে করে বলতেন, আসলে মেয়েদের জন্য শিক্ষকতাই শ্রেয়। বলতেন, দৃঢ় মনোবল, ব্যক্তিত্ব ও বোধ বুদ্ধির প্রাখর্য না থাকলে এসব কর্মস্থলে মেয়েদের জন্য অতল গহ্বরে পতন অনিবার্য হতেও পারে।
নাগরিক নেতা
অধ্যক্ষ মোহম্মদ হোসেন খান সালমাকে নাগরিক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এডভোকেট শফিউল আলম বলছেন, চট্টগ্রাম কলেজে ইউএস পিপির ছাত্র সংসদ ও ছাত্র আন্দোলনে যে ৪–৫ জন তুখোড় ছাত্রীকর্মী ছিলেন তার মধ্যে সালমা চৌধুরী শীর্ষে। তিনি পরবর্তীতে সংগঠক হয়ে উঠেন। সমাজসেবা অঙ্গনে তার কর্মতৎপরতা ভূয়সী প্রশংসার দাবীদার– তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্যা; বাংলাদেশ গার্লস গাইড এসোসিয়েশনের আঞ্চলিক কমিশনার; চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক মহিলা সদস্য; প্রথম সাবেক মহিলা সদস্য, সিডিএ; সাবেক মহিলা কমিশনার, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন; ভাইস প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রাম মহিলা ক্রীড়া সংস্থা; মহাসচিব, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি; নির্বাহী সদস্য, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক একাডেমী ও পাহাড়িকা গার্লস হাই স্কুল; জেলখানা পরিদর্শক সদস্য; চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের প্রাক্তন সদস্য; ডিরেক্ট মার্চেন্ট কো অপারেটিভ ব্যাংক; উপদেষ্টা, দৃষ্টি, নবীন মেলা; দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে লায়নিজমের সাথে যুক্ত এবং ১৯৮৪–৮৫ সালে বাংলাদেশের লায়নেস ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এর তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের সদস্য হয়ে কখনও তিনি কোনো সুযোগ সুবিধা আদায় করেননি। দেবার চেষ্টা করেছেন। নেবার চেষ্টা করেননি। তাঁর ছায়াসঙ্গী অধ্যাপিকা হামিদা চৌধুরী বলেছেন, ‘গাইড ও ৩০৫ বাকলিয়া হাইস্কুলের রোডে চট্টগ্রাম গাইড হাউস’ ছিল তার সেকেন্ড হোম।
দুঃখের পাষাণে ঘষা সুবাসী চন্দন
সালমা চৌধুরী শেঙপীয়ারের নাটক অভিনয় করেছেন। দর্শক সারিতে তার পিতা ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। আহমদ ছফার ভাষায় সাদা বাঘের মত। আংশিকভাবে সালমা চৌধুরীর জীবন ছিল শেক্সপীয়রের নাটকের মত ট্র্যাজেডির একটি অংশ। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল মাজেদ বলছেন, ‘কান্না–হাসির দোল–দোলানো পৌষ–ফাগুনের মেলা’ এ সংসারের বিপর্যয় ও ক্ষতি তাঁকে সাময়িকভাবে বিচলিত করলেও শক্ত হাতের বৈঠা তিনি কখনো ছাড়েননি। ১৯৮২ সনে পিতার মৃত্যু (৮০ বৎসর বয়সে), মায়ের বৈধব্য, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের দীর্ঘদিন রোগ–ভোগ, ১৯৬৯–এ প্রথম স্বামী লে. সালেহ চৌধুরীর, ৯২ সনে দ্বিতীয় স্বামী কায়সার চৌধুরীর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যু–যন্ত্রণা তাঁকে নিত্যকার কর্মজীবন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কলেজে অনেকবার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁকে বলতে দেখেছি–প্রিন্সিপাল সাহেব, কী দোষে আমার বার বার এ নিদারুণ–দু:সহ পরীক্ষা।’ কবি আবুল হাসানের ভাষায় আমরা বলি, ‘সালমা চৌধুরী হচ্ছেন দুঃখের পাষাণে ঘষা সুবাসী চন্দন’।
মূলত তিনি ছিলেন নাগরিক আন্দোলনের নেতা, উচ্চশিক্ষিত সংস্কৃতিবান প্রগতিশীল মহিলা। দীপালি ভট্টাচার্য বলছেন, টিপটপ পিনআপ করা কাপড়, ব্যাকব্রাশ করা ফোলানো ফাঁপানো কেশরাজি, মার্জিত আচরণ সংযত ব্যবহার। আপাতদৃষ্টিতে অংহকারী। অনন্য ব্যক্তিত্ব সালমা চৌধুরী ছিলেন গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় জন রহিত।
ব্যক্তিজীবনে অপরিসীম কর্মদক্ষতা, অপার ভালোবাসা ও স্নেহমমতার নাম সালমা চৌধুরী। শুধুমাত্র মুদ্রাওয়ালা সন্তান থাকলেই তাঁদের পিতা–মাতাকে স্মরণ করা যাবে, এটা যথাযথ নয়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রমা একটি শোকসভা করেছিলেন। প্রয়াত বন্ধু সাখাওয়াত হোসেন মজনু জীবন ও কর্মে সালমা চৌধুরী নামে শীর্ষক একটি শোককাতর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা করেছেন। আমরা আশা করব, উইমেন এম্পাওয়ারমেন্টের বিংশের অগ্রপথিক সালমা চৌধুরীর জীবন ও কর্ম অনুসরণ ও অনুকরণ করার জন্য বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে ইনডেপথ ও আপডেটেডভাবে মূল্যায়ন করবে এবং তাঁর অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও পদ্যসমূহ প্রকাশের উদ্যোগ নেবেন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সাবেক সচিব ও
প্রধান নির্বাহী, সিসিসিআই