সার্ক-এর ভাঙন কি তাহলে আসন্ন!

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী | শনিবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশচীনকে নিয়ে প্রস্তাব নতুন আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইশহাক দার বলেন, প্রয়োজন হলে এশিয়ার বাইরের দেশগুলোকেও এই সহযোগিতা কাঠামোয় যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশচীনপাকিস্তানের কূটনীতিকদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি ও জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়, যা এই উদ্যোগের ভিত্তি তৈরি করেছে। যা আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে। সাম্প্রতিক কালে উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতপাকিস্তান সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে, আর সাম্প্রতিক এরপর বাংলাদেশভারত সম্পর্কেও অস্বস্তি বেড়েছে। সার্ক কার্যত অচল হয়ে আছে ২০১৬ সালে ভারতপাকিস্তান উত্তেজনার পর থেকে। ২০২৪ সালে আগস্ট মাসে বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ভারতের সাথে বর্তমান সম্পর্কও অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানপাকিস্তান, বাংলাদেশভারত, ভারতপাকিস্তান, ভারতনেপাল সীমান্ত সমস্যা এটা দিন দিন আরো বেশি দূরত্ব তৈরী করছে, এছাড়া সাম্প্রদায়িক সমস্যা তো রয়েছেই।

১৯৮০ সালে বাংলাদেশের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে এই অঞ্চলের দেশগুলো একত্রিত হয় এবং ১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের অষ্টম সদস্য হিসেবে যোগদান করে, ফলে সদস্য সংখ্যা ৮টিতে উন্নীত হয় যার মূল লক্ষ্য ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। চীন ও জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তিশীল রাষ্ট্র সার্কের পর্যবেক্ষক। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান ও মরিশাসকে সার্কের পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথ খুলে যায়। ১৯৮৫ সালের ঢাকা সম্মেলনে এর সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদিত হয়, যার ফলে দক্ষিণ সার্কের মূলনীতি ও লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও দ্রুত অর্থনৈতিক উনয়ন সাধন করা। সার্বভৌম সমতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ না করা এবং পারস্পরিক সুবিধার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উনয়নের জন্য নিবেদিত, সম্মিলিত স্বনির্ভরতার উপর জোর দেওয়া। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২৫টি বছরে এর সনদ অনুযায়ী ২৫টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে সার্কের সর্বশেষ ১৮তম সালের পর আর কোনো শীর্ষ সম্মেলেন হয়নি। এর প্রধান কারণ ভারতের বিরোধিতা। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে সার্কের ১৯তম সম্মেলন না হওয়ার পেছনে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ছিল প্রধান কারণ। ভারতশাসিত কাশ্মীরে একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলা হয়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। তাই সার্কের ১৯তম সম্মেলন আর আলোর মুখ দেখেনি। দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির অঙ্গীকার করা হলেও আশানুরূপ তেমন অগ্রগতি আসেনি। নিকট প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও সার্ক দেশগুলোর সাধারণ মানুষ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হতে পারেনি বরং সন্ত্রাসের বিস্তার ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় নিয়ে প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলছে।

সার্ক গঠনের পরবর্তীতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য এই পর্যন্ত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় চুক্তি দুটি হচ্ছে ১৯৯৩ সালে SAPTA (SAARC Preferential Trading Arrangement) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৯৫ সালে কার্যকর হয়। SAPTA চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেটি অর্থবহ হয়নি। ২০০৬ সালে SAFTA (South Asian Free Trade Area) কার্যকর হয়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল SAPTA চুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন করা এবং বাণিজ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ২০০ কোটির বেশি মানুষের বাজার থাকলেও সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক বাণিজ্য মাত্র ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ। বাণিজ্য সমন্বয়ের কথা থাকলেও সার্কভুক্ত দেশে দেখা যায় পণ্য আমদানীরপ্তানীতে বিভিন্ন ধরনের বিধি নিষেধ আরোপের ঘটনা অথচ মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সেটি কোনওভাবেই সুখকর নয়।

শুধু রাজনৈতিক ভাবে নয় ক্রীড়া ক্ষেত্রে বর্তমানে এই মাঠ অচলাবস্থা চলমান। খেলাধুলায় দুই দলের বা দুই পক্ষের হাত মেলানো শুধু তো আর আনুষ্ঠানিকতা নয়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও এটি পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। অনেক বছর ধরে সাফ গেম্‌স অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। সর্বশেষ সাফ গেমস অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডু ও পোখরায়। তবে, ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে, সর্বশেষ পুরুষদের সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ ২০২৩ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এশিয়া কাপ ক্রিকেট নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। ভারতপাকিস্তানের এমন মনোভাব আমরা দেখেছি এশিয়া কাপ ক্রিকেটে, যেখানে খেলোয়াড়রা সৌজন্যতা বিনিময় থেকে বিরত থাকেন। এমনকি ভারতের ক্রিকেটেররা কাপও গ্রহণ করেনি। ভারত দল যা শেষ পর্যন্ত নারী দলকেও এমনটা করতে দেখা যায়। যদি পেহেলগাম হামলায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে অপরাধীদের ধরুন। খেলায় রাজনীতি টেনে আনা খেলাধুলার মূল চেতনার পরিপন্থী।

সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ বলা যায়। একটা মহৎ উদ্দেশ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও এই সংস্থাটি এখন শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ। যদি সার্ক ভেঙে যায় তাহলে হয়তো এর অধিকাংশ দায়ভার ভারতের উপর পড়বে।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে