সারের সংকট, দ্বিগুণ দাম

১১শ' টাকার টিএসপি বিক্রি হচ্ছে ২২শ' টাকায় ।। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ বিঘ্নিত

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

দেশের কৃষি সেক্টরে সার সংকট চলছে। দ্বিগুণ দামেও জুটছে না সার। জাহাজে এবং গুদামে হাজার হাজার টন সার মজুদ থাকলেও কৃষকের কাছে না পৌঁছার জন্য পরিবহন সংকটকে দায়ী করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ঘাটে ঘাটে সার আটকা পড়েছে। যা কৃষকের কাজে লাগছে না।
সূত্র জানিয়েছে, কৃষির ভর মৌসুম চলছে। ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া মিলে সব ধরনের সারই প্রয়োজন কৃষকের। বিশেষ করে চারা রোপণের সময় টিএসপি এবং ডিএপি সার দেওয়া হয়। ইউরিয়া দেওয়া হয় চারা কিছুটা বড় হওয়ার পর। কিন্তু চট্টগ্রামসহ সারাদেশের কৃষকরা চাহিদা মোতাবেক সার পাচ্ছেন না। হাজার হাজার কৃষক সারের জন্য হাহাকার করছেন। ১১শ’ টাকার টিএসপি সার বিক্রি হচ্ছে ২২শ’ টাকা। বিদেশ থেকে আমদানি করা টিএসপি সার বিক্রি হচ্ছে ১৬শ’ টাকা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সারের বিশাল মজুদ থাকার পরও এখানে জুটছে না সার। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। সারাদেশে সারের একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চক্রান্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সারের এই সংকটে দেশের কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশংকা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শীতকালীন সবজি উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
সূত্র বলেছে, দেশের কৃষিখাতের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সরকার দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদিত সারের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও প্রচুর সার আমদানি করে থাকে। বিদেশ থেকে চড়া দামে কেনা সার সরকার ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করে। দেশে বিসিআইসির তালিকাভুক্ত সাড়ে সাত হাজার ডিলার সার বিক্রির সাথে জড়িত। বিদেশ থেকে বেসরকারি পর্যায়েও নন ইউরিয়া সার আমদানি হয়ে থাকে। সরকারি এবং বেসরকারি মিলে বর্তমানে চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে প্রচুর সার রয়েছে। সার রয়েছে কাফকো, সিইউএফএল, ডিএপি এবং টিএসপিসহ সবগুলো কারখানায়। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন গুদামেও রয়েছে প্রচুর সার। কিন্তু কৃষকদের কাছে সার পৌঁছাচ্ছে না। চড়া দামে কিংবা দ্বিগুণ দামে কৃষকদের সার কিনতে হচ্ছে। সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলার এবং আমদানিকারকদের একটি অংশ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সংঘবদ্ধ চক্রটি কৃষকদের পকেট কাটছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক কৃষক।
সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, সীতাকুণ্ডে সার বিক্রিতে সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নির্ধারিত সেই দামে সার বিক্রি না করার অভিযোগ করেছেন কৃষকেরা। অভিযোগ রয়েছে, ডিলার ও সাব-ডিলাররা (খুচরা বিক্রেতা) সরকার নির্ধারিত দাম উপেক্ষা করে তাঁদের মনগড়া দামে সার বিক্রি করছেন। খুচরা বিক্রেতাদের দোকানে মূল্যতালিকা ঝুলিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে ১০ জন ডিলার ও ১০০ জন সাব-ডিলার রয়েছেন। সার উত্তোলনের সময় বিসিআইসি প্রদত্ত টাকার রসিদ এবং কৃষকদের মধ্যে সার বিক্রির রসিদ উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ডিলাররা তা জমা দেন না। সরকার কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়ার দাম প্রতি কেজি ১৬ টাকা, টিএসপি ২২ টাকা ও এমপির (মিউরিয়েট অব পটাশ) দাম ১৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে ডিলার ও সাব-ডিলাররা বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।
কৃষক এরশাদ, হাতিলোটার জহিরুল ইসলাম, সৈয়দপুরের বোরহান ও আবুল কালামসহ কয়েকজন বলেন, ডিলার বা সাব-ডিলাররা দোকানে মূল্য তালিকা রাখেন না। এ কারণে তাঁরা সরকার কর্তৃক সারের নির্ধারিত দাম সম্পর্কে জানতে পারেন না। তাঁদের বেশি দামে সার কিনতে হয়। দোকানে মূল্য তালিকা নেই কেন জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সার বিক্রি না করার হুমকি দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের বোদ্দার পুকুরপাড় গ্রামের সাব-ডিলার গৌরাঙ্গ কুমার নাথ বলেন, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। লোকসান পুষিয়ে নিতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কিছু বেশি টাকায় সার বিক্রি করছি। তবে সৈয়দপুর ইউনিয়নের ডিলার মজিবুর রহমান ও বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের ডিলার নুর মোস্তফা দাবি করেন, তাঁরা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যেই সার বিক্রি করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিব উল্লাহ বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে ডিলার ও সাব-ডিলারদের সার বিক্রি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা মানছেন না, তাঁদের চিহ্নিত করে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
গতকাল বিসিআইসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে সারের কোনো অভাব নেই। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আট লাখ টনেরও বেশি ইউরিয়া মজুদ রয়েছে। মজুদ রয়েছে আড়াই লাখ টন টিএসপি। দুইটি ডিএপি কারখানাসহ সারাদেশে অন্তত সাত লাখ টন ডিএপি সার মজুদ রয়েছে। এই সার দিয়ে ভর মৌসুম সামাল দিতে কোনো সমস্যাই হতো না। কিন্তু এত সার থাকার পরও কৃষকদের কাছে সার পৌঁছাচ্ছে না। সারের অভাবে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
গতকাল একাধিক সার ডিলারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, এটি আসলে সার সংকট নয়, সংকট পরিবহনের। লাইটারেজ জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ট্রাক ভাড়া। এতে করে চট্টগ্রামের গুদাম থেকে সার উত্তোলন করে তা দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠানোর পরিবহন খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। শুধু ভাড়াই বাড়েনি, প্রয়োজনীয় ট্রাকও পাওয়া যাচ্ছে না। লাইটারেজ জাহাজেরও সংকট। এতে করে সার সরবরাহ নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। ফলে বাজারে একটি সংকট তৈরি হয়েছে।
গতকাল বিসিআইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারের কোনো সংকট নেই। তবে কৃষকের হাতে সার পৌঁছাচ্ছে না। এটি দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি। অচিরেই এই সংকটের সুরাহা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সারের সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের সভাপতি সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেশব্যাপী সারের একটি সংকট তৈরি হয়েছে। তবে এটি খুবই সাময়িক। আসলে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সময় মতো সার আমদানি করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আমদানিতে সংকট তৈরি হয়েছে। এরপর দেশে সার আসার পর তা অভ্যন্তরীণ নৌপথে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহেও সংকট তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় লাইটার পাওয়া যায়নি, এখনো যাচ্ছে না। ট্রাকের ভাড়া বহু বেড়ে গেছে। ট্রাকও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে চট্টগ্রাম এবং মোংলায় প্রচুর সারের মজুদ থাকলেও তা বিভিন্নস্থানে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে না। এরফলে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা দ্রুত এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবো বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠিত হয়
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙা কারখানায় লোহার আঘাতে শ্রমিকের মৃত্যু