সারের চাহিদা ও মজুদে ব্যাপক ঘাটতি, সংকটের শংকা

ইউরিয়ার চাহিদা ১৪ লাখ টন, মজুদ ৫ লাখ ৭৫ হাজার টন ১৬ বছরে সরকারের অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকা হরিলুট

হাসান আকবর | শুক্রবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

দেশের কৃষিখাতে দেয়া ভর্তুকির ৯৮ শতাংশই দেয়া হয় সারে। অথচ ভর্তুকির হাজার হাজার কোটি টাকার সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। কোটি কোটি টাকার সার গায়েবসহ সংঘবদ্ধ চক্রের নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারের দেয়া ভর্তুকির টাকা হরিলুট হচ্ছে। গত ১৬ বছরে সরকারের অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। অপরদিকে দেশে কৃষির ভর মৌসুমে সার সংকটের আশংকা করা হচ্ছে। চাহিদা এবং মজুদের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি থাকায় এই শংকা প্রকট হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানিয়েছে, সরকার প্রতিবছর কৃষিতে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। আমদানিকৃত এবং দেশীয় সার কম দামে কৃষকদের হাতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দেয়া হয় ভর্তুকি। গত অর্থবছরে সরকার কৃষিতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। গত ১৬ বছরে এ ভর্তুকির পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার সার পাচার এবং মেরে দেয়ার কারনে সরকারি ভর্তুকির হরিলুট হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘবদ্ধ চক্র লোকচক্ষুর অন্তরালে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে।

বিসিআইসির অসাধু কর্মকর্তা, সার পরিবহনের ঠিকাদারসহ সরকারিবেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা চক্রটি কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে। আমদানিকৃত সার পরিবহনের ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্স পরিবহনের আড়ালে প্রায় আড়াই লাখ টন সার গায়েব করে দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে গুদামে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে সরকারি সারের চালান বুঝে নিলেও তা গুদামে না দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয় বলে সরকারি বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে। পোটন ট্রেডার্স একাই গায়েব করেছে প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার সার। পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান পোটন একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদও। তিনি সার সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নরসিংদী২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। আমদানিকৃত সার সরকারি গুদামে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ২০২১ সাল থেকে তাকে দফায় দফায় চিঠি এবং তাগাদা দেয়া হলেও তিনি তা করেননি। অবশেষে বিসিআইসি মামলা দায়ের করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

একইভাবে চট্টগ্রামের নবাব এন্ড কোম্পানির মালিক নবাব খান গায়েব করে দেন ৬১৯ কোটি টাকার সার। এই সারও পরিবহনের আড়ালে গায়েব করে দেয়া হয়। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এসব সার গায়েব করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত সরকারের ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৫৬ টন সারের মধ্যে ৬৬ হাজার ৮৭৪ টন সার চট্টগ্রাম থেকে বুঝে নিলেও নবাব খান তা বাফারে না দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। সরকারের এই সার কেনায় খরচ হয়েছিল ৬১৯ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৯ টাকা। নবাব খানের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিন্তু গায়েব করে দেয়া সারের কোনো সুরাহা হয়নি।

এভাবে পরিবহনের আড়ালে সরকারের কোটি কোটি টাকার সার গায়েব করে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ ভর মৌসুমে কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়ে পরে দাম কমলে খোলাবাজার থেকে কিনে সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আবার আমদানিকৃত সার পরিবহনকালে চুরি করে বিক্রি করে দেয়ার পর নানা গোঁজামিল দিয়ে বস্তার ওজন বাড়িয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সূত্র বলেছে, গত ১৬ বছরে কৃষিখাতে সরকার ভর্তুকি দেয় ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। এর ৯৮ শতাংশই দেয়া হয়েছে সারে। অথচ অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির মাধ্যমে সেই ভর্তুকির একটি বড় অংশ নয়ছয় করা হয়। মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি হাতিয়ে নিয়েছে ভর্তুকির কোটি কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভর্তুকির টাকা হরিলুট হয়, আমদানিকৃত সার গায়েব হয় অথচ দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের সার নিয়ে নানা ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে। বাজারে সার সংকট দেখিয়ে চড়া দামে হাতিয়ে নেয়া হয় কৃষকের টাকা।

সূত্র জানায়, দেশের কৃষিখাতে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি (পটাশ)- এই চার ধরনের সারই সাধারণত প্রধান সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে ইউরিয়া সার আমদানি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। অন্যান্য সারগুলো আমদানি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। দেশে চলতি বছর ৬৫ লাখ টনেরও বেশি সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, সাড়ে ৭ লাখ টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), সাড়ে ১৬ লাখ টন ডিএপি (ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট) এবং সাড়ে ৮ লাখ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সারের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮ লাখ টন।

বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন সার কারখানাগুলোতে বছরে ইউরিয়া সার উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। এর বাইরে কাফকোতে উৎপাদিত সব সারই সরকার আন্তর্জাতিক দরে এবং বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রয় করে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার ইউরিয়া সার আমদানি করে।

দেশে ইউরিয়া সার নিয়ে অতীতে নানা ধরনের তেলেসমাতি ঘটেছে। চলতি বছরও ইউরিয়া নিয়ে শংকা ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। বোরো মৌসুমের জন্য আগামী চার মাসে দেশে অন্তত ১৪ লাখ টন ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে বিসিআইসির বিভিন্ন বাফার গুদামে সারের মজুদ রয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টন। অবশ্য আমদানিকৃত আরো দেড় লাখ টন সার পাইপ লাইনে রয়েছে। যা আগামী কিছুদিনের মধ্যে দেশে পৌঁছাবে বলে সূত্র জানিয়েছে। টিএসপি সারের আগামী চার মাসের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার টন। এই সারের মজুদ রয়েছে ১ লাখ ২ হাজার টন। ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার টন, মজুদ আছে ১ লাখ ৩৯ হাজার টন। এমওপি সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ১৩ হাজার টন। মজুদ রয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার টন।

চাহিদার তুলনায় মজুদের পরিমাণ কম থাকায় সার সংকটের শংকা করা হচ্ছে। তবে সরকার আমদানি বৃদ্ধি কিংবা গ্যাসের সংস্থান করে দেশীয় সার কারখানাগুলোকে পুরোদমে উৎপাদনে নিয়ে সংকট মোকাবেলা করতে পারে বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

বিসিআইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেছেন, কৃষি সেক্টরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। সার আমদানির প্রক্রিয়াও চলছে। প্রয়োজনের সময় কৃষকদের দোরগোড়ায় যাতে সার পৌঁছে সরকার সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তবে ভর্তুকির টাকার হরিলুটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, অতীতে রাজনৈতিক চাপসহ প্রভাবশালীদের কারণে বহু কিছু ঘটেছে। এখন আর ওইসবের কোনো আশংকা নেই। শত শত কোটি টাকার সার গায়েব করে দেয়া মানুষকেও আগে কিছু বলা যায়নি, এখন আর সেই অবস্থা নেই। ভর্তুকির টাকার সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে বহু অনিয়ম রোধ করতে হবে বলে তিনি জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাহাজ থেকে বিদেশ পালানো ১৯ নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
পরবর্তী নিবন্ধটাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে যুবকের অর্ধগলিত লাশ