সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী মধ্যম নাথপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো কেমন আছেন?
: জনশ্রুতি রয়েছে ত্রিপুরার রাজা বনি মোহন নাথ চৈত্র্য সংক্রান্তীর অনুষ্ঠানে হাতি ও ঘোড়া সাজিয়ে আসতেন মধ্যম মাইজপাড়া গ্রামে। ব্রিটিশদের যুগে এই অঞ্চলের নাম ছিলো কাট্টলী। কায়েতটুলী (কায়েত অর্থ শিক্ষিত, টুলি অর্থ আবাস স্থল অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষের আবাসস্থল) থেকে লোকমুখে প্রচার পায় কাট্টলী। পাকিস্তান আমলে প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য কাট্টলী অঞ্চলকে দু’টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে নামকরণ হয় উত্তর ও দক্ষিণ কাট্টলী। আর এই অঞ্চলটি অর্থাৎ মধ্যম মাইজপাড়া দক্ষিণ কাট্টলীর ভাগে পড়ে। আরও একটু পেছনে যেতে চাই। উত্তর ও দক্ষিণ কাট্টলী অঞ্চলে ব্রিটিশ সময়ে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ছিলেন। ত্রিপুরার রাজা ও তার রাজবাহিনী অবস্থান নিতেন সাগর জনপদ বেষ্টিত মাইজপাড়া গ্রামে। বিশাল একটি মেলার আয়োজন হতো। গ্রামের কৃষকরা শুকনো মৌসুমে ধানের খালি জমিতে তাদের পণ্য নিয়ে দোকান সাজাতেন। ব্যবসা বাণিজ্য হতো। এই মেলার বিস্তার ছিলো পুরো এলাকা জুঁড়ে। সাধারণ মানুষ এবং বণিক ব্যবসায়ীরা পুরো অর্ধ বছরের আয় রোজগার সেরে নিতেন। তখন জমিগুলোতে দো ফসলী শস্য উৎপাদন হতো। মেলার পাশাপাশি চৈত্র্য সংক্রান্তির দিনে ভোজ পর্বের ব্যবস্থা থাকতো। ১৯৪৭ এর পর প্রচুর হিন্দু ভারতে চলে যান। হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির মেলা বন্ধ হয়ে যায়। তবে ৫০ এর দশকে প্রাণহরি বাবু চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হননি। কারণ অনেক বনেদি অর্থ বিত্তের মালিক অনেক হিন্দু চলে গিয়েছিলেন।
সেই মাইজপাড়াই এখন শহীদ মধ্যম নাথপাড়া হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিচিত। কেন গ্রামটির নামের বদল হয়েছে? সংক্ষিপ্ত তথ্য হলো এরকম। ৩১ মার্চ বুধবার ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রামটির অবস্থান ছিলো হালিশহর ই পি আর ক্যাম্পের অতি নিকট দূরত্বে। সেখানে বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানী সৈন্যদের ২৫ মার্চ রাতেই নিরস্ত্র করে ফেলেছিলো ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম এর নেতৃত্বে। ২৮ মার্চ থেকে পাকিস্তানী নৌবাহিনী এবং বন্দর অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা একযোগে ই পি আর ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ শুরু করে। প্রতিরোধে চলে যায় বাঙালি সৈন্যরা। যুদ্ধের এই সময় পুরো সাগর বেষ্টিত এলাকার মানুষ বাঙালি সৈন্যদের শুকনো খাদ্য ও পানীয় জল পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মাইজপাড়ার এই গ্রামে ছিলেন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতাকর্মী। তারা ১ মার্চের পর থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন। এই গ্রামে নিয়মিত আসতেন এম.এ. আজিজ। তাঁর গ্রামের বাড়ি এই গ্রামের নিকট দূরত্বে আনন্দ বাজার। ৭০ এর নির্বাচনে মাইজপাড়া ও আবদুর পাড়ায় এম.এ. আজিজ ও ইসহাক মিয়ার নির্বাচনী অফিস ছিলো। নৌকার প্রতীক নিয়ে এলাকার মানুষ নিজ এলাকার বাইরে হালিশহরের বিভিন্ন ব্লকে নির্বাচনী প্রচারে বের হতেন। এতে করে অবাঙালি কিছু মানুষ এই পাড়া দু’টির প্রতি ছিলো বিরক্ত। পাকিস্তানী বাহিনী ই পি আর ক্যাম্প দখলে নেওয়ার পূর্বেই বাঙালি সৈন্যরা বড় যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন পথে পিছু হটে আসে। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৫০ জনের মতো ই পি আর সৈন্য এই মধ্যম মাইজপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। তখন তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। ক্লান্ত দেহ মন নিয়ে তারা রাত থেকে বিশ্রামে ছিলেন এবং তাদের পোশাক ছেড়ে গ্রামবাসির দেওয়া লুঙ্গি, শার্ট পরে অন্যত্র সরে পড়ার জন্য মন্দির সংলগ্ন মাঠে অপেক্ষায় ছিলেন। এলাকার বিহারি ব্লকের অবাঙালিদের মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনী সকালে (সকাল ৮টা) পুরো মাইজপাড়া ঘেরাও করে ফেলে। গ্রামের মানুষ বুঝে ওঠার পূর্বেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। কিছু মানুষ পালাতে পারলেও বেশির ভাগই হত্যার শিকার হন। মাত্র দু’ঘন্টার মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা করে ঘাতক অবাঙালি বাহারির ছেলেরা এবং অস্ত্র ব্যবহার করেছিলো পাকিস্তানী বাহিনী। হত্যার কৌশল ছিলো এ রকম,
১. তালোয়ার দিয়ে জবাই করে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে জমিয়ে রেখেছিলো।
২. বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুকুরে ফেলেছিলো।
৩. শিশুদের বল্লম ও তলোয়ারের মাথায় ঝুলিয়ে হত্যা করেছিলো।
৪. সন্তানদের হত্যা করে সে রক্ত দিয়ে মাকে গোসল করিয় দিয়েছিলো।
৫. ৬ দফার কর্মীকে ৬ টুকরো করে উল্লাস প্রকাশ করেছিলো।
৬. আগুণে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো।
৭. বস্তায় পুরে পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলো।
এই গ্রামের এমন একটি পরিবার নেই যাদের পরিবার হত্যার শিকার হননি। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশর মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও অর্থায়নে স্বাধীনতা স্মৃতি ট্রাস্টের নামে একটি স্মৃতি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। সেখানে এই গ্রামের ৪২ জন শহীদের নাম পাওয়া গিয়েছিলো এবং আবদুর পাড়ার ৫ জনের নাম। যারা ভাড়াটে ছিলেন, ভাসমান মানুষ, ই পি আর শহীদের নাম পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন প্রায় ২০০ জন বাঙালিকে হত্যা করেছিলো অবাঙালির ছেলেরা পাকিস্তানী বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। যারা সেদিন গ্রামের বাইরে ছিলেন, অথবা আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন তারা প্রাণে বেঁচেছিলেন। গ্রামের মহিলাদের অবাঙালি আনোয়ারের বাড়িতে আটকে রেখে পরে ছেড়ে দেয়। অবাঙালি ছেলেরা প্রতিটি ঘরের সম্পদ লুন্ঠন করে নেয়, ভিটি খুঁড়ে দেখেছে লুকানো সম্পদ আছে কিনা। এমন কি প্রতিটি ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত খুলে নিয়ে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। যারা বেঁচে ছিলেন পাড়া প্রতিবেশির সাহায্যে চলে গেছেন দূরে এবং প্রায় সবাই আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে।
দীর্ঘ ৯ মাস পর স্বাধীন দেশে তারা ফিরে এলেন। পোড়া মাটিতে তারা পেলেন স্বজনদের হাঁড় ও মাথার খুলি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে তারা বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা নিজেরা মাইজপাড়াকে নামকরণ করলেন শহীদ মধ্যম নাথপাড়া হিসেবে। তাঁরা চেয়েছিলেন,
১. গ্রামটি শহীদ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পাক, পরিবারগুলো মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাক শহীদ পরিবারের।
২. প্রতিজন গ্রাবাসী শহীদের মর্যাদায় সম্মান পাক, সমাজ স্বীকৃতি পাক।
এসেছেন মন্ত্রী, এম পি, কমান্ডার্স ফোরামের মানুষ জন কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। তারা শুধু টিভি বা পত্রিকার লেখার খোরাক হয়েছেন কিন্তু শহীদ স্বীকৃতি মেলেনি।
এই গ্রামের মানুষ শিক্ষায় এগিয়েছে জীবন যুদ্ধ করে। তাদের জীবন জীবিকার সমৃদ্ধ অঙ্গন নেই, কাজের অভাবে আছেন অনেকে। তাই এখন প্রয়োজন
১. শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত শহীদ পরিবারের সন্তানদের চাকরির ব্যবস্থা করা।
২. যারা অসহায় নিয়মিত চিকিৎসা করাতে পারছেন না বা সংসার চলে না তাদের নিয়ে ভাবতে হবে।
এতোগুলো বছর পরও তাদের পাশে আমরা কেউ নেই। তাই গ্রামের মানুষকে মুখ দেখাতে লজ্জা পাই। কারণ স্বপ্ন ছিলো তারা শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাবেন। গত ১৩ এপ্রিল সে গ্রামে যেতে হয়েছিলো একটি টিভি অনুষ্ঠানের জন্য। সুনীল, মৃণাল ও খুকুদের বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখি পুরো উঠান জুড়ে নোংরা পানির প্রবাহ। বলার কেউ নেই, ধনাঢ্য বহুতল ভবনের অদৃশ্য পানিতে ভাসছে শহীদ পরিবার ও পুঁজোর ঘর। এভাবেই শহীদ গ্রামের শহীদ পরিবারগুলোর অবস্থান। আর কতো অবজ্ঞা করবেন একাত্তরের শহীদ পরিবারগুলোকে? সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ আহমদ এবং বি টি ভি’র মানুষরা শুনেছেন পরেশ চন্দ্র দেবনাথ, নারায়ণ চন্দ্র বৈষ্ণব, খুকু রাণী দেবী, সুনীল কান্তি নাথ, কুজ্ঞলতা দেবী, প্রভা রাণী দেবী, অঞ্জলী রাণী দেবী প্রমুখদের পরিবারের হত্যাকান্ডের কাহিনী। পাকিস্তানী ঘাতক হাবিলদার মেজর শমসের বেগ এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ঘাতক আনোয়ার, শফি উল্লাহ, শওকত হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করে। এই শহীদ গ্রাম ও শহীদ পরিবার গুলোর প্রকৃত তথ্য নিয়ে ‘শহীদ মধ্যমনাথ পাড়া ও আবদুর পাড়া ট্র্যাজেডি’ নামকরণে একটি গ্রন্থের কাজ চলছে’ তথ্য চাই।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনের দিকে জরুরিভিত্তিতে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়