: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু-বিপ্লবী আগ্রাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধে আগ্রাবাদ।
: ১৬৬৬ খিস্টাব্দে মুঘল রাজবাহিনী মগ স্থল ও জলদস্যুদের দমনের জন্য একটি অগ্রবর্তী দলকে নদী ও সমুদ্র বন্দর অভিমুখে পাঠিয়েছিলো। সেই অগ্রবর্তী দলের নামানুসারে স্থানটির নাম হয়েছিলো আগ্রাবাদ। এটি একটি জনশ্রুতি। আগ্রাবাদ বলতে তখন উত্তর আগ্রাবাদ, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, উত্তর পাঠানটুলী, দক্ষিণ পাঠানটুলী, দেওয়ানহাট ও গোসাইল ডাঙ্গার অংশকে বুঝাতো। পরবর্তী ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই স্থানগুলোর আলাদা আলাদা নামকরণ হয়েছে। আগ্রাবাদ নামটির ব্যাপকতা পেয়েছিলো বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিশেষ করে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ৯ম শ্রেণির পাঠ্যতালিকায় পাকিস্তান সরকার ‘দেশ ও কৃষ্ঠি’ নামে একটি বই পাঠ্য করেছিলো। সেই বইতে ৮৫ শতাংশ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়গুলো স্থান পেয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের এবং ১৫ শতাংশ ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের। ফলে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয় এই বইটিকে পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। ছাত্রদের এই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে আগরতলা মামলা দায়ের করেন প্রেসিডেন্টে আইয়ুব খান। বাঙালি ছাত্র সমাজ, এই মামলাকে ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে উল্লেখ করে জীবনপণ সংগ্রাম শুরু করেন। ছাত্রলীগ এই আন্দোলন শুরু করলে মজলুম নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেখ মুজিবের মুক্তি, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শ্রমিক, জনতা এবং সম্মিলিত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে পাকিস্তান সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্যহন এবং প্রত্যাহার করা হয় আগরতলা মামলা। বলা প্রয়োজন যে, ১৫ ফেব্রুয়ারিতে জেলখানায় পাকিস্তান সরকার অন্যতম আসামী বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহরুল হক-কে গুলি করে হত্যা করলে আন্দোলন ভয়াবহরূপ ধারণ করেছিলো। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত মতো শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। সেদিন থেকে বাঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু শব্দটির উদ্ভাবক ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা, নিউক্লিয়াসের সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী মুসতাক।
মুক্তির ৬ দিন পর বঙ্গবন্ধু এলেন চট্টগ্রামে। বিমান বন্দর থেকে পথে পথে বঙ্গবন্ধু সংবর্ধনা পেলেন। সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা হয়েছিলো বাদামতলী মোড়ে। তোরণ নির্মাণ হয়েছিলো বাঁশ ও ছন দিয়ে। অসংখ্য ছবি বঙ্গবন্ধু ও এম.এ. আজিজ এর। এম.এ আজিজ বঙ্গবন্ধুকে দেশ কৃষ্ঠি ও আগরতলা মামলায় আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের ছেলেরা কি কি ভূমিকায় ছিলেন তা জানালেন। এই সভার আয়োজক ছিলো আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু খোলা জিপে দাঁড়িয়ে ৫ মিনিট বক্তব্য রাখলেন। তিনি আন্দোলন সংগ্রামের সময় আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের আন্দোলন ঐতিহ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আগ্রাবাদ বিপ্লবী আগ্রাবাদ। তোমরা বিপ্লবী আগ্রাবাদের ছাত্রলীগ কর্মী, বিপ্লবী আগ্রাবাদের জনগণ। সন্ধ্যার পর শাহজাহান হোটেলে এসো বিপ্লবী আগ্রাবাদের ছাত্রলীগের ছেলেরা। বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। সবার মুখে মুখে স্লোগান আগ্রাবাদ বিপ্লবী আগ্রাবাদ। সেসময় আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ কি ভূমিকা রেখেছিলো,
১. প্রায় প্রতিদিনই এলাকার স্কুল কলেজের ছাত্ররা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মিছিল মিটিং করতেন।
২. ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সেনাবাহিনীর সাথে পাথর নিক্ষেপ যুদ্ধে ছিলেন।
৩. ১৫ ফেব্রুয়ারির পর কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল হয়েছে।
৪. অনেক ছাত্রলীগ নেতা কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের ছেলেরা বঙ্গবন্ধুকে মানপত্র দিয়েছিলেন। মানপত্র লিখেছিলেন ও পড়েছিলেন আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক আগ্রাবাদ স্কুলের ছাত্রী সৈয়দ লুৎফর রহমান (পরে মুক্তিযোদ্ধা) বঙ্গবন্ধু সবার সাথে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, ছাত্রলীগ মানে ভালো ছেলে, ভালো ছাত্রদের সংগঠন। নিয়মিত পড়ালেখা করবে। আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ ছিলো জেলা কমিটির প্রতি দুর্বল। কারণ ছাত্র নেতারা ছিলেন জেলা কমিটির নানা পদে। সংগঠক ছিলেন চৌধুরী আলী রেজা, তোহা গাজী, শফি উল্লাহ, তাজুল ইসলাম, জাকারিয়া চৌধুরী, বিশেষ করে তোহা গাজী এবং শফি উল্লাহ থাকতেন বাদামতলীতে, তাজুল ইসলাম ও জাকারিয়া চৌধুরী ছিলেন কমার্স কলেজের ছাত্র। ফলে তাদের প্রভাব ছিলো আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের ওপর। তাছাড়া এলাকার স্কুল ও পাড়ার ছাত্রলীগের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিলো তোহা গাজী ও তাজুল ইসলাম এর। কাজী গোলাম সারওয়ার মজনু, গোলাম মোস্তফা তারা কলেজের ছাত্র এবং থাকতেন আগ্রাবাদ ঢেবার পাড়ে। ফলে তারাও ছিলেন আঞ্চলিক শাখার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তাছাড়া জেলা ছাত্রলীগের নেতা সাবের আহমদ আজগরী, ডা. মাহফুজুর রহমান, প্রফেসর ফজলুল হক, রওশন আরা আনার, ডা. গোফরানুল হক, আবদুল আহাদ চৌধুরী, ফাহিম উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম রাজু, আবুল কাশেম, দেওয়ান মাকসুদ, আ জ ম সাদেক সুকুমময় চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, বদিউল আলমসহ অনেক ছাত্রনেতা। সবার নাম লিখতে পারিনি বলে দুঃখিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ নৌকার পক্ষে ছিলেন নিবেদিত। এখান থেকে ১২ নভেম্বর ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর এম.এ. আজিজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ত্রাণকর্মী হিসেবে হাতিয়া, চর জাব্বার, চর আলেকজেন্ডারে গিয়েছিলেন। নির্বাচনে এম.এ. আজিজ ও ইসহাক মিয়া এম.এন.এ ও এম.পিএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন ইসহাক মিয়া আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের পাশে ছিলেন। এম.এ. আজিজ মারা যান ১১ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুতে আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলো এবং শোক সভা করে কর্মীদের চাঙ্গা রেখেছিলো। এই অঞ্চলের নেতা কর্মীরা ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সবাই ছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এবং পরবর্তী ৯ মাস পর্যন্ত এই আগ্রাবাদের গৌরব জনক ভূমিকার মধ্যে ছিলো।
০ আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি মসজিদ মাইক থেকে ২৬ মার্চ সকাল ৮টা, ১০টা ও ১১টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা মাইক যোগে প্রচার করে।
০ অপারেশন আমেরিকান এক্সেপ্রেস, অপারেশন হোটেল আগ্রাবাদ, অপারেশন চট্টগ্রাম শিপিং কোম্পানি, অপারেশন ওয়াপদা ট্রান্সফরমার, অপারেশন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা, অপারেশন আগ্রাবাদ, দেবা ওয়াটার পাম্প, অপারেশন মফজল কেরানী বাড়ি আল্ শামস্ ক্যাম্প, অপারেশন ফায়ার সার্ভিস, অপারেশন কাবুলিদের আস্তানা, অপারেশন গোসাইল ডাঙ্গা পেট্রোল পাম্প, অসংখ্য বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার অপারেশন মুক্তিযোদ্ধারা সম্পন্ন করেছিলেন। এই আগ্রাবাদের বিভিন্ন বাড়িতে অন্তত: ৪২টি আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিলো আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় স্থাপিত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের গোয়েন্দা সদর দপ্তর। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে ১২টি স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ স্থানে শুরু হয়েছিলো। আরো বলা প্রয়োজন যে, আগ্রাবাদ অঞ্চলের আনন্দিপুর গ্রামে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা পবিত্র কোরান শপথ নিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করবেন। আগ্রাবাদের গ্রামীণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থাপিত হয়েছিলো। অসংখ্য ছাত্রলীগের ছেলে এবং সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, ভারত গিয়েছিলেন, স্থানীয়ভাবে অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। অনেক অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়ে সফল করেছিলেন। হোটেল আগ্রাবাদ এবং আমেরিকান এঙপ্রেস ব্যাংক অপারেশন করে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বের সামনে এবং জাতিসংঘে প্রমাণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ঐতিহাসিক অপারেশান জ্যাকপটের সমস্ত অস্ত্র এই আগ্রাবাদ দিয়েই নদির দক্ষিণ পাড়ে অপারেশন সূচনা স্পটে নেওয়া হয়েছিলো। অস্ত্রগুলো আগ্রাবাদের বিভিন্ন গ্রামীণ স্থানে গোপনে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি আগ্রাবাদকে যে সম্মান দিয়েছিলেন আগ্রাবাদ ছাত্রলীগ এবং আগ্রাবাদের জনগণ তাঁর সম্মান রেখেছিলেন।
তখন পুরো শহর চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের দুর্গ ছিলো আগ্রাবাদ আঞ্চলিক শাখা, পাহাড়তলী আঞ্চলিক শাখা, জামাল খান আঞ্চলিক শাখা, চকবাজার আঞ্চলিক শাখা। এই শাখাগুলোতে প্রভাব ছিলো জেলা ছাত্রলীগের। তবে শহর ছাত্রলীগের মধ্যে বিশেষ নেতারাও কমিটি করে গেলে জেলা ছাত্রলীগ তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রাখতেন। এই অঞ্চলের ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য। ১ মার্চের পর সব বিপরীত স্রোত একস্থানে মিশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।