: ফরিদের পাড়া এক দফার প্রবক্তা চট্টগ্রাম শার্দুল এম এ আজিজ-এর শেষ জনসভার স্থান। স্থানটি বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও এলাকায়। একজন ওলী আল্লাহের নামকরণে এই গ্রামের নাম ফরিদের পাড়া হয়েছে। সে ওলী কি শেখ ফরিদ কিনা এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। পাশের শমশের পাড়াও এমন একজনের নামেই নামকরণ হয়েছে। বিস্তারিত তথ্য গবেষণার কাজ শেষে হলে পরে জানানোর চেষ্টা করা হবে। আজকে বলতে চাইছি অন্য কথা। মৃত্যুর পূর্বে এম এ আজিজ-এর শেষ জনসভার কথা।
সেদিন ছিলো ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। পুরো বাঙালি জাতির একক নেতায় পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা তাঁকে এই সম্মান মর্যাদা প্রদান করতে চায় না। অন্যদিকে বাঙালিরা পাকিস্তান শাসন করুক সেটাও চায় না পাকিস্তানী শাসকচক্র। ১৯৭০-এর নির্বানের পর থেকেই বাঙালিদের ওপর কঠোর অবস্থানে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করে পাকিস্তানীরদের চক্রান্তের জাল একে একে ছিন্ন করেই চলছিলেন। এম এ আজিজ কিন্তু কৌশলী হলেন না। তিনি সরাসরি বলেই ফেললেন, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী যদি ৬ দফার প্রশ্নে বাঙালিদের সাথে বেঈমানী করে তাহলে এই চট্টগ্রাম থেকেই শুরু হবে ‘এক দফার’ সংগ্রাম। প্রথমে তিনি মিরসরাই অঞ্চলের জনসভায় এমন বক্তব্য দেন এবং গ্রেফতার হয়ে যান। প্রবল আন্দোলনের মুখে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। মুক্তির পরও তিনি এই বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকেন নি। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে ছাত্রলীগ একদফা বাস্তবায়নের জন্য প্রকাশ্যে স্লোগান তুলেছিলেন এবং এম এ আজিজ-কে সমর্থন দিলেন। সেই তখন থেক্ে এম এ আজিজ পরিচিতি পেয়ে যান এক দফার প্রবক্তা হিসেবে।
এই মানুষটি ১৯৭০-এর নির্বাচনে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এম এন এ ও এম পি এ মনোনয়নে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। বিভিন্ন বই পড়ে জেনেছি বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নমিনেশন বোর্ড এম এ আজিজ এর চিন্তা ও সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি। টেকনাফ থেকে ফেনী নদির দক্ষিণ পাড় পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নে এবং পরে এক দফার প্রশ্নে এম এ আজিজ এর পক্ষে সবাই অবস্থান নিতে শুরু করেন। তিনি দীব্যদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে কিছু মুসলিম লীগ পরিবার আছে যারা সমাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রভাবে তারা জমিদার। তাদের নিয়ন্ত্রণের মানুষগুলো প্রজার মতোই। জমিদার বা ঐ মুসলিম লীগ পরিবারের কথার বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেন না। তৃণমূলে কাজ করতে গিয়ে এম এ আজিজ বৃহত্তর চট্টগ্রামের একেবারে সাধারণ মানুষের চরিত্র বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে গোপন পরামর্শ করে মুসলিম লীগের কিছু শক্ত অবস্থান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনবেন। সে সিদ্ধান্তের আলোকে তিনি চিহ্নিত করলেন চট্টগ্রামের কিছু প্রভাবশালী মুসলিম লীগ পরিবারকে। কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন? জবাবটা ছিলো- এই রকম,
১. নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগ তাদের অর্থওয়ালা ভালো প্রার্থী দেবে। তাদের থাকবে অর্থ জোর ও স্থানীয় প্রভাব।
২. তারা পাবে প্রশাসনের প্রকাশ্য ও গোপন সহযোগিতা।
৩. তাদের নিয়ন্ত্রিত মানুষগুলো ন্যায় অন্যায় বুঝে না কর্তা যেখানে বলবে ভোট সেখানেই দেবে হবে।
উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে তিনি কিছু ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগে যোগদান করার চিন্তা ভাবনা করেন। এতে তিনি সফল হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ পরিবারের এমন কিছু তরুণকে আওয়ামী লীগে আনলেন যাঁরা ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, রুচিবান এবং মানুষের শ্রদ্ধার। তিনি ৭০-এর নির্বাচনে তাদের দলের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। ফল এলো এবং তিনি সফল হলেন। দল লাভবান হলো। বলা যায় এই ভাবে,
১. চট্টগ্রামের মুসলিম লীগের প্রভাবশালী পরিবারগুলো মানসিক ভাবে দুর্বল হলেন।
২. তাদের প্রজারা নৌকার প্রার্থীর জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেন।
৩. তাদের জন্য দল কোন অর্থ ব্যয় করতে হয়নি, উল্টো তারা দলকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছিলেন।
৪. আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা মুসলিম লীগ সমর্থকদের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে পড়েননি।
৫. মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুসালিম লীগ পরিবার মুক্তিযোদ্ধা এবং বাঙালিদের পাশে ছিলেন।
এই পদক্ষেপ ছিলো এম এ আজিজ এর রাজনৈতিক কৌশল। তাঁর এমন কৌশলের নিকট পাকিস্তানী প্রশাসন পরাস্ত হয়েছিলো। সেদিন (৩১ মার্চ) ফরিদের পড়ার একজন বই প্রেমিক মানুষের সাথে আজিজ দর্শন নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তিনি নিজাম উদ্দিন ফরিদী। স্বাধীনতার সময় ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন, কমার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি জানালেন এম এ আজিজ ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ সকালে যান ফটিকছড়ি মীর্জাবু-দের বাড়িতে। সে বাড়ির ছেলে মীর্জা মনসুর তখন নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এম.পি.এ) তাঁদের বাড়িতে ছিলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান। তিনি খেলেন প্রতিদিনের তুলনায় কিছুটা বেশি। পথে পথে কয়েকটি জনসভা করলেন। তারপর রাতে এলেন ফরিদের পাড়ায়। তাঁদের বাড়ির নিকট দূরত্বে খেলার মাঠে জনসভা করলেন, প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছিলো। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মালেক উকিল এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। পাড়ার ছেলে বুড়ো এই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঐ সভায়ও পাকিস্তানীদের চক্রান্তের কথা বলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সচেতন থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরে তিনি কঠোর কন্ঠে উল্লেখ করেছিলেনযে, পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমাদের এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার কথা ভাবতে হবে। অনেক রাতে সভা শেষ হয়েছে।
রাত গভীর হয়েছে। হঠাৎ প্রকৃতির নীরবতা ভেঙ্গে মাইকের আওয়াজ ভেসে এলো। নাজিম উদ্দিন ফরিদীর পিতা আলহাজ্ব আবদুল মালেক ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন ছেলেকে, দেখো মাইকে কি বলছে? শোনা গেলো এবং জানা গেলো যে, এম এ আজিজ স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেছেন। শোকে মুহ্য হলেন পুরা এলাকার মানুষ। যে লোকটি মাত্র দু’ঘন্টা আগে পাশের মাঠে দেশের কথা ভেবে, বাঙালিদের কথা ভেবে, আওয়ামী লীগের কথা ভেবে দেশের স্বাধীনতার পরামর্শ দিলেন সে মানুষটি মারা গেছেন। পুরো চ্টগ্রাম শোকের নগরীতে পরিণত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু এলেন, দেশের সকল দলের জাতীয় নেতারা এলেন সেই এক দফার প্রবক্তা এম এ আজিজ-এর কফিনের পাশে, জানাযায়। এই মানুষ শেষ কথা বলার স্থান, রাজনীতির শেষ বক্তব্য দেওয়ার স্থান, এক দফার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানের স্থানটি এখনো অনেকের নিকট অপরিচিত। সবাই জানেন বহদ্দার হাট ছিলো তার জনসভার স্থান কিন্তু স্থানটি যে চান্দগাঁও অঞ্চলের ফরিদের পাড়া তা কিন্তু আমারও জানা ছিলো না। এলাকার প্রবীনরা ছাড়া এ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না এই তথ্যটি। এখনতো শুধু চলছে শ্লোগানের রাজনীতি কিন্তু গবেষণার কাজ তারা করছেন না। তাইতো সংকট বাড়ছে।
অনুরোধ প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে, অন্তত: এম এ আজিজ এর শেষ জনসভার স্থানটির পাশে অথবা ঐ এলাকার সংলগ্ন যে কোন অবস্থানে লিখে দেওয়া যায় যে, স্থানটি এম এ আজিজ এর শেষ বক্তৃতার বা জনসভার স্থান। তাহলে পথচারি বা এলাকার মানুষ তথ্যটি পাবে। অনুরোধ জানাচ্ছি এলাকাবাসী প্রবীনদের তাঁদের নিকট মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য উপাত্ত রয়েছে। অনেক কথা বলার রয়েছে, রয়েছে অনেকগুলো আশ্রয় কেন্দ্র। মা-বোনদের ভূমিকা এমন তথ্য সংগ্রহে কাজ করছি। অনুগ্রহ করে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান। প্রয়োজনে ০১৭১২-৯৯১৬১৮ এই নম্বরে ফোন করলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।