সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

: শিশু সন্তানদের রক্ষা করুন।
: চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কিছু শিশু সন্তান নষ্ট হচ্ছে, কিশোর অপরাধের বিস্তার বাড়ছে, কিশোরদের পথ ভ্রষ্ট করছে। নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার হচ্ছে এবং কিছু অভিভাবক দিনদিন অসচেতন হচ্ছেন। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কেউ কেউ শিশু কিশোরদের মঙ্গলের চিন্তা করে বাধ্য হয়ে সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবকের নিকট গিয়ে উপদেশের স্বরে বলেন, আপনার শিশুটির দিকে খেয়াল রাখবেন, আপনার দৃষ্টির বাইরে ছেলের চালচলন ভালো ঠেকছে না। পিতা হিসেবে আপনি যা দেখেন না আমাদের চোখে তা ধরা পড়ছে। খারাপ ছেলেদের সাথে তার চলাফেরা বাড়ছে। ভালো ছেলেটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অভিভাবক কিছু সময় চুপ করে থেকে যদি বলেন, আপনার চরকায় তেল দিন, আমার ছেলের সব খবর আমি রাখি। তাহলে বলুনতো কেমন লাগবে! বিপরীত চিত্র হচ্ছে এমন উপদেশে অনেক অভিভাবক বিনয়ের সাথে বলেন, আপনাকে ধন্যবাদ। স্কুল বন্ধু, পড়ালেখার চাপ কম। তাই বাবা অফিস মুখি হলে সন্তান মা’র চোখকে ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে চলে যাচ্ছে সীমানার বাইরে।
সেখানে তারা কি করছে?
ইদানীং কালে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। বয়সের কারণে তাদের চালচলন, আচার আচরণ চোখে পড়ে না। চোখে না পড়ার কারণ হচ্ছে অন্য এলাকায় বা এমন স্থানে চলে যায় যেখানে পরিচিত মানুষ থাকে না। তারপরও এমন কিশোরদের অপতৎপরতা পথচারিদের চোখে পড়ে। যেহেতু তাদের বয়স ১৮ বছরের কম তাই তাদের শিশুই বলা হচ্ছে আইনে। এরা যখন দলসহ চলে তাদের থাকে একজন দু’জন কথিত বড় ভাই। তাদের নির্দেশনায় চলে ঐসব শিশু কিশোরা। এদের শ্রেণিগত ব্যাখ্যা রয়েছে।
১. বস্তির শিশু কিশোর।
২. অভিজাত ঘরের শিশু কিশোর।
বস্তিতে যারা বেড়ে ওঠে বা বসবাস করে তাদের প্রায় সবাই কোন না কোন কাজ করে। অর্থাৎ তারা নিজেরা আয় করে সংসার চালায়। কারণ দিন শেষে তারা ঘরের জন্য চাল ডাল সংগ্রহ করতে হয়। তাদের বেশির ভাগই টোকাই গোছের, কাগজ বা প্লাস্টিকের বোতল বা ময়লা আবর্জনা থেকে এমন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে যেগুলো ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করলে টাকা পাওয়া যায়। এদের বেশির ভাগই অসহায় বাবা-মা, ভাই-বোনদের মুখে অন্ন তুলে দেয়। এদেরই কেউ কেউ বস্তির মাস্তান স্বভাবের বড় ভাইদের নির্দেশনা অনুযায়ী এমন কাজ করে যা কিনা তাদের খারাপ পথে নিয়ে যায়। অনেকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিশোর অপরাধী বনে যায়। তখন এমন অপরাধীদের কদর বেড়ে যায় যারা অপরাজনীতি করে। এইতো কিছুদিন আগে দেখেছি নির্বাচনের সময় রাতে পোস্টার লাগাচ্ছে কিছু শিশু কিশোর। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোন প্রার্থীর পোস্টার লাগাচ্ছো? উত্তর না দিয়ে পোস্টার খুলে দেখালো। তারা স্পষ্ট বলেছে এখানে এক হাজার পোস্টার আছে রশিতে বাঁধানো, সেগুলো টাঙ্গাতে পারলে আমাদের চারজনকে ৬০০ টাকা দেবে। অর্থ হলো পুরোরাত পোস্টার টাঙ্গালে জনপ্রতি ১৫০ টাকা পাবে। এদের অন্যতম কাজ হচ্ছে অন্য প্রার্থীর পোস্টারের দড়ি কেটে দেওয়া। এদের বয়স ১২ থেকে ১৫ এর মধ্যে। ঠান্ডা লাগছে বলে সবাই সিগারেট টানছে। এরা একজনের নির্দেশনা মেনেই এই কাজের ঠিকাদারী নিয়েছে। তাদের চাল চলন এবং কথার ঢং দেখে মনে হলো তারা বিভিন্ন অপরাধ করছে। জানা গেলো এরা ছোট খাটো চুরি করে। এরা আস্তে আস্তে অপরাধ জগতে পা দিতে শুরু করেছে।
অভিজাত ঘরের কোন কোন শিশু ঘরের টাকা চুরি করে এমনসব স্থানে আড্ডায় বসে সেখান থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রথম দিকে তারা তাদের নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে নেতার পক্ষে স্লোগান তোলা, মানুষের নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে আনা, নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করা। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে অপরাধ জগতের গহীনে। তারা যখন ঘরে ফেরে তখনতো তারা সুবোধ বালক। বাবাকে ম্যানেজ করতে কষ্ট হলেও তারা মাকে মিথ্যা বলে ম্যানেজ করে ফেলে। তারা মার আশ্রয়ে থেকে এবং মার ভালোবাসার সুযোগের অপব্যবহার করে বনে যাচ্ছে কিশোর অপরাধী। এমন মার সংখ্যা শতকরা হারে কতোজন সে গবেষণা নেই তবে সংখ্যায় কম নয়। এধরনের শিশু কিশোর অপরাধীরা প্রথম দিকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়, তারপর মেয়েদের ইভটিজিং করে, ধূমপানে আসক্ত হয় এবং পরে মাদকদ্রব্যে অভ্যস্থ হয়ে জীবনটাকে ধ্বংস করে দেয়।
মূলবিষয় হচ্ছে পরিবারের শিক্ষা। যেসব পরিবার সন্তানদের নিয়ে চর্চা করেন বা গবেষণা করে তাদের সন্তানরা বিপথে যেতে পারে না। পরিবার থেকেই তারা নৈতিক অবস্থানে থাকে। খবর নিয়ে দেখবেন কোন পরিবারের সন্তান খারাপ পথে যাচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে বলা যায়,
১. যে পরিবারের বাবা-মা বেশি উদাসীন, সন্তানের খবর রাখেন না।
২. যে পরিবারের পিতা বিদেশে থাকেন এবং মা সন্তানকে অতিমাত্রায় আদর দিচ্ছেন।
৩. সন্তানের হাতে টাকা দিচ্ছেন প্রশ্ন না করে।
৪. সন্তান প্রতিদিন কার সাথে মেলা-মেশা করছেন বা তাদের বন্ধু কে।
৫. সন্তানের স্বভাবের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কিনা সে খেয়াল রাখছেন না।
৬. নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে কিনা এবং স্কুল ছুটির পর সন্তান কোথায় যাচ্ছে।
আরো অনেক কারণ থাকতে পারে তবে প্রধান অপরাধ হচ্ছে পরিবারের উদাসীনতা। পরিবার যদি এমন শিশু কিশোরদের প্রতি তদারকী রাখতেন বা বাড়াতেন তাহলে প্রথম থেকেই তাদের গতিবিধি স্পষ্ট হয়ে যেতো, অনেক অভিভাবক অন্যের সন্তানদের দায়ী করে বলেন … এর ছেলেই আমার ছেলেকে খারাপ করেছে। আবারো উল্টো উদাহরণও আছে তাহলো অন্যের দোষ দেবো কেন আমাদের দোষেই ছেলে নষ্ট হয়েছে। শিশু কিশোরদের অপরাধী বানাচ্ছে কারা? প্রশ্নের উত্তর হবে উদাসীন পরিবার এজন্য দায়ী। ঘরের শিক্ষা, পরিবারের শিক্ষাই হচ্ছে মৌলিক শিক্ষা। ঘরের শিক্ষা নৈতিক হলে শিশু কিশোর খারাপ হবে কেন? শেষ কথা হচ্ছে আপনার সন্তানের অপরাধ আপনার চোখে পড়ছেন ঠিকই কিন্তু অন্যের চোখে সেগুলো ধরা পড়ছে। তাই প্রয়োজন সচেতনতা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেব্রুয়ারি এলেই একুশের চেতনা জাগ্রত হয়
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ত্রিরত্ন এখন শুধুই স্মৃতি