: অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান- সাধারণ পোশাকের অসাধারণ মানুষ।
: এমাসেই তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী। আপাদমস্তক খদ্দরের কাপড়ে ঢাকা এই মানুষটি কিংবদন্তি। পুরোটা জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন কাগজ ও কলমের সাথে সক্ষ্য সম্পর্ক গড়ে। এই লাইনটির ব্যাখ্যা দিতে চাই। কেন তাঁকে কাগজ কলমের বন্ধু বলা হয়।
১. ছোট বেলায় কলাপাতায় লিখেছেন কাগজের বিপরীতে এবং কলম ছিলো বাঁশের কঞ্চি।
২. কিশোর বেলায় বাবা, দাদার মিষ্টির দোকান বিখ্যাত খান সুইটসের ক্যাশে বসে হিসাব কাগজ কলমে।
৩. ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে কাগজ কলমের চিরকুট ছিলো ভাষা সংগ্রামী ছাত্রদের জন্য নির্দেশনা।
৪. ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে মিছিল, মিটিং, স্লোগান, রাজপথ কাঁপানো কর্মযজ্ঞ এবং জেলখানা থেকে কাগজ কলমের চিরকুট সংগ্রামী ছাত্রদের জন্য ছিলো সরকারি প্রশাসনের সাথে আপোষ না করার নির্দেশনা।
৫. ৬ দফাকে সমর্থন দিয়ে শিক্ষক হিসেবে এর পক্ষে অবস্থান এবং চিরকুটের সাহায্যে সতীর্থদের পক্ষে থাকার অনুরোধ।
৬. ১৯৬৮-৬৯ এর আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ছাত্রদের গোপন নির্দেশনা ছিলো সেই কাগজ কলমের চিরকুট।
৭. ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র শক্তির প্রাক্তন সদস্যদের দেশের জন্য বাঙালি জাতির জন্য কাজ করার চিরকুট পাঠাতেন।
আর সামনে যেতে চাই না। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর কিছু আড্ডার স্থান ছিলো। আনোয়ারা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে একটি আড্ডার স্থান করে নিয়েছিলেন। কর্মজীবন অর্থাৎ শিক্ষকতা জীবনের ঢাকার পর্ব থেকে করে চলে আসেন চট্টগ্রামে। তারপর কমার্স কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ হয়ে ডেপুটেশনে অধ্যক্ষ হয়ে আসেন এম ই এস কলেজ। এসময় তাঁর আড্ডার স্থান ছিলো,
১. আন্দরকিল্লাহ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের দো’তলা এম.এ. মালেকের চেম্বার।
২. দৈনিক আজাদী সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এর চেম্বার।
৩. কদম মোবারকে নিশান প্রিন্টিং প্রেস।
এই আড্ডাগুলো ছিলো সৃজনশীল এবং স্মৃতি কথা। ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে চর্চা এবং মজার আসর জমানো। এই আসর ছিলো জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল মানুষের মিলন কেন্দ্র। এমন একটি আড্ডার আসরের কথা বলছি। তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিপূর্ণ ভাবে শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম শহর বাঙালি সৈন্যদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। মানুষ আশ্রয়ের জন্য গ্রামমুখি। হত্যা, নির্যাতন প্রায় নিত্যদিনের কাজ পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে। শহর নীরব। জীবন চলছিলো পুতুলের মতো করে। মৃত্যুটা ছিলো প্রতিজন মানুষের জন্য নির্ধারিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা ছিলো প্রেরণার উৎস। খবর পাওয়া যাচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধারা শহরে এসে গেছে, তারা গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানী, পাকিস্তানী সৈন্য ও স্থাপনায় আঘাত হানছে। এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থায় একটি আড্ডার আসর বসতো সকাল, বিকেলে। তাঁরা সবাই ছিলেন রাজনৈতিক বিবেচনায় তমুদ্দুন মজলিশ এবং একসময়ের ছাত্রশক্তির বন্ধু। তবে সবাই ছিলেন ভাষা সংগ্রামী। কেমন করে তারা একত্রিত হলেন সেটাও ইতিহাসের অংশ। প্রসঙ্গটি ছিল এরকম,
১. অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান শুরু করলেন কাগজ কলমের যুদ্ধ এবং চিরকুট কালচার।
২. দু’চার শব্দে চিরকুট লিখে সতীর্থ বন্ধুদের নিকট পাঠালেন।
৩. জীবন ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আড্ডায় আসলেন, বসলেন এবং গোপন নির্দেশনা তৈরি করলেন।
৪. এতোটাই গোপন ছিলো যে, তারা যখন বসতেন তখন পাকিস্তান রেডিও’র ভলিয়ম বাড়িয়ে দিতেন।
৫. বসার স্থান ছিলো ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল ইসলাম এর ঘাটফরহাদবেগ এর বাসা। আসতেন যাঁরা তারা শহরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভাষা সংগ্রামী এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গোপন সৈনিক।
৬. তাঁরা সুকৌশলে ভারতের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ পাঠাতেন।
৭. সরকার, পাকিস্তানী বাহিনী যাদের দুষ্কৃতকারী বলতেন তারাই ছিলেন বাঙালি প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আর তারা যাদের দেশ প্রেমিক বলতো আসলে তারা ছিলো ঘাতক পাকিস্তান বাহিনী, আলবদর, আল্ শামস্, রাজাকার বাহিনীর সদস্য। পত্রিকায় পাতায় দুষ্কৃতদের তথ্য প্রচার হলে সবাই খুশী হতেন। এরাই গেরিলা যোদ্ধা।
৮. এই তথ্যগুলো অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান কাগজে কলমে লিখে বাহক মারফত অর্থাৎ বদরুল হুদা চৌধুরীর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাতেন।
৯. তাঁরা গরম কাগড়, অর্থ, ওষুধ সংগ্রহ করতেন এবং পাঠাতেন সংশ্লিষ্ট আশ্রয় কেন্দ্রে।
১০. এই আড্ডার সতীর্থরা দায়িত্ব নিয়ে কিছু মানুষের তালিকা তৈরি করে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতেন, সাহস যোগাতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
এই আড্ডার সতীর্থদের গোপন কার্যক্রমের ফলে যারা মুষড়ে পড়েছিলেন তাঁরা জেগে উঠলেন, সাহসী হলেন এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জন্য কাজে লেগে গেলেন। মাঝে মাঝে তারা নীরব হতেন, স্থান বদল করতেন। ফলে ঘাতক ও তাদের দোসররা আড্ডার মানুষদের সন্দেহ করতেন না। তাদের আরো কিছু কাজ ছিলো,
১. বিভিন্ন দপ্তরে যারা উচ্চ পদে ছিলেন তাদের সাথে কথা বলে সুকৌশলে পাকিস্তানী প্রশাসনের খবর সংগ্রহ করতেন।
২. কর্মক্ষেত্রে কারা ঘাতক বাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে অতিমাত্রায় যোগাযোগ রাখতো তাদের তালিকা করে স্থানীয় যোদ্ধাদের নিকট পাঠিয়ে তাদের সাইজ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতেন। তবে হত্যার পরামর্শ দিতেন না।
৩. পথ ঘুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের স্থাপনাগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের নিকট পাঠাতেন। স্থানীয় রাজাকার, আল্ বদর, আল্ শামস এবং অতিমাত্রায় পাকিস্তান পন্থিদের তালিকা করতেন।
এই আড্ডার মানুষরা ঈদ উৎসব বর্জনের লিফলেট ও পত্রিকাগুলো নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন। দেশের প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর তথ্য কাটিং করে বন্ধু মহলে প্রচার করতেন। পাকিস্তানীদের প্রকাশিত সংবাদ এবং তথ্য উল্টো করে তাঁরা বুঝে নিতেন। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান একসময় খুব ভালো পোস্টার লিখতেন, ছবি আঁকতেন। ভাষা আন্দোলন এবং শিক্ষা আন্দোলনের সময় তাঁর নিজের লেখা পোস্টার এবং ছবি নিয়ে অনেক প্রকাশনার প্রচ্ছদ হয়েছিলো। ৬ দফার সময় তিনি একটি মুখোশ তৈরি করে কয়েকজন ৬ দফা পন্থীকে দিয়েছিলেন। একই ভাবে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাতক বাহিনীর একটি ব্যঙ্গ চিত্র এঁকে রেখেছিলেন কিন্তু প্রকাশ প্রচার করেননি।
আজীবন খদ্দরের পায়জামা, পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি ছিলো তাঁর পোশাক। তবে টুপি সুন্দর করে পকেটে রাখতেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরতেন। গলায় ঝুলাতেন খদ্দরের ব্যাগ। বুক পকেটে রাখতেন প্রিয় বন্ধু কলমকে। এতোটা সাধারণ ধাচের জীবন চলা মানুষটি হঠাৎ মরে গেলেন। কিছু বুঝতে পারেনি পরিবার ও বন্ধুরা। মৃত্যুর পরই সবাই জানলেন অসাধারণ মানুষ, বিরস রচনার মানুষ, প্রাণ খোলা হাসির মানুষ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান চলে গেছেন হাসির আভা মুখে নিয়ে। মৃত্যুর পর সবাই বলেছেন সাধারণ পোশাকের অসাধারণ মানুষ আমাদের প্রিয় বন্ধু, সুহৃদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।