সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ৯ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

: কিশোর অপরাধ বাড়ছে, পারিবারিক শিক্ষা নির্বাসনে …।
: শিশুটির বয়স কতো হবে, সাত থেকে নয়। খেলছিলো আরো দু’জন সমবয়সির সাথে। কি হতে কি হয়ে গেলো বুঝে ওঠার আগেই একজন শিশুর হুংকার। তোকে আজ খতম করে দেবো। এই বলেই দেয় ছুট। ফিরলো একটি ছুরি নিয়ে। ফল কাটার ছুরি। সাথের দু’জন ভয়ে যারযার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ছুরি হাতে শিশুটি দু’চারটে মন্দ কথা বলে, গাল মন্দ দিয়ে সিনেমার খল নায়কের মতো অ্যাকশন দেখিয়ে চলে গেলো নিজ ঘরে। এটা কোন কল্পকাহিনী নয়, সিমেনার ডায়লগ বা দৃশ্য নয়। অনেকদিন আগে দেখা একটি ঘটনা যা সত্য ঘটনা। এমন অ্যাকশনের জন্য শিশুটির বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ তোলেনি, প্রতিবাদ করেনি। কারণ যার সন্তান তিনি বা তারা মন্দ মানুষ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ বা প্রতিবাদ করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সাধারণ শান্তি প্রিয় মানুষ হিসেবে তারা প্রতিবাদের পথটাকে পরিহার করে নীরব ছিলেন। এবার বলছি শিশুটির পরিবার প্রসঙ্গে।
এক. পিতা এবং চাচার প্রায় প্রতিজন বন্ধু সমাজ অপরাধী। তাদের সহযোগিরা দলবদলে পারদর্শী। তারা সবসময় সরকারি দলের সমর্থক। ঘরে প্রতিদিন এমন সব অ্যাকশনের ছবি দেখে যা সুস্থ মন বিকাশের পরিপন্থী।
দুই. ঝগড়া ঝাটি, অন্যের প্রতি উগ্রতা প্রদর্শন, দম্ভ নিয়ে পথ চলা, মুখের ভাষা অরুচিকর এবং অন্যকে অশ্রদ্ধা করা, পরচর্চা ও পরনিন্দা, প্রতিপক্ষকে দেখে নেবে, শেষ করে দেবে এমন বচন ঘরেই চর্চা চলে।
এমন একটি পরিবারের শিশু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবস্থান নেয় একটি অনৈতিক পরিবেশে। পিতা এবং চাচার মুখের বুলি এবং গালি তার চর্চার বিষয়। সেতো ঘরে এবং পরিবারে নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না অথবা নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার মতো মানুষতো এই পরিবারে নেই। পরিবারতো একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাগার। এই শিশুটিতো পরিবার থেকে সুশিক্ষা পাচ্ছে না, যা সে পাচ্ছে তা কুশিক্ষা। এর প্রভাব কি দেখছি,
১. শিশুটির মাঝে জন্ম নিয়েছে উগ্রতা, অশালীন আচরণ।
২. অন্যকে দমন ও ঘায়েল করার জন্য হাতে তুলে নিয়েছে ছুরি।
একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কথা বলেছি। এখানে নিম্নবিত্ত পরিবার নিয়ে কথা নয়, বরং শুধু একটি পরিবার। অন্য দিকে নিম্নবিত্ত অসংখ্য পরিবার রয়েছে যারা ঘর বা পরিবারকে আদর্শস্থানীয় করে রেখেছেন। এখানে শুধু খারাপ প্রভাবের ঐ বিশেষ পরিবার নিয়ে কথা হচ্ছে, ব্যাপক অর্থে নিম্নবিত্তের পরিবার নয়।
এবার বলছি উচ্চ বিত্তের একটি পরিবারের কথা। পরিবারের পিতার প্রচুর অর্থ। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেও প্রাথমিক পর্যায় শেষ করেছেন বলে মনে হয় না, তবে গাল গল্পে সেরা। ছেলেরা পড়ালেখা করছে কিন্তু মানুষ হতে পারছে না। কারণ তারা এখন শুধু আধুনিক নয় অত্যাধুনিক। তাদের চাল চলন হচ্ছে,
১. গভীর রাতে ঘরে ফেরা, আড্ডার আসরের বন্ধুরা মুখ দিয়ে প্রচুর ধূয়া ছাড়ে, মাদক দ্রব্যের নেশার কাছে তারা হিরো, বাবা-মা’র নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শাসনের উর্ধে চলে গেছে তারা।
২. পিতার দর্শন হলো অন্যের হক মেরে সামাল দিতে পারলে মন্দ কি।
পরিবারের প্রধান কর্তা পিতা, তিনিতো নিজেই অন্যায় করে ছেলের সামনে আদর্শ বিসর্জন দিয়েছেন। পিতার হাতে সিগারেট তিনি কিভাবে পুত্রের ধূমপান বন্ধ করবেন? কেউ ছেলের অন্যায়ের কথা বললে, পিতার জবাব ছেলে ইংলিশ স্কুলে পড়ে একটু সিগারেটতো খাবেই, বন্ধুতো থাকবেই। উল্লেখ্য যে ছেলে বদ স্বভাব, বদ আচরণ এবং মাদকদ্রব্য সেবনের দায়ে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, বয়স মাত্র ১২ বছর।
এই অল্প বয়সী ছেলেটা নষ্ট হলো কেন? তাদেরতো ধনের অভাব নেই, সুখ বিলাসের শূন্যতা নেই। তারতো সুখের কমতি নেই, ঘরে বাইরে বিনোদনের অভাব নেই। এতো থাকার পরও সে তার ঘরকে নরক বানালো কেন? এর জবাব সংগ্রহ করেছি এভাবে
১. পিতা-মাতা আদর্শহীন জীবন, সম্পদ বাড়নোর প্রতিযোগিতা।
২. পরিবারকে পাঠশালা বানানোর বদলে ঘরকে করেছে অনৈতিক কাজের আখড়া।
৩. ঘরে বা পরিবারে নৈতিকতার ছোঁয়া নেই, শুধুই পরচর্চা ও পরনিন্দার ফোয়ারা।
ফলে ছেলেটি বেড়ে ওঠেছে অশুদ্ধ পরিবেশে। সন্তানের অন্যায় পিতা-মাতা সোহাগ দিয়ে মেনে নিয়েছেন। যখন নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হলো তখন পাখি অনেক উপরে ওঠে গেছে, অনৈতিকতার শেকড় অনেক নিচে চলে গেছে। ফলে নৈতিকতার খালিস্থান আর পূরণ হলো না।
এই দু’টি শিশুর জীবন পরিক্রমায় আমরা দৃশ্যত কিছু বিষয় আলোচনায় আনতে পারি। শিশু দু’টি নষ্ট হচ্ছে, নষ্টের ধারায় তারা এগুচ্ছে পরিবার, পরিবারের সদস্যদের আশ্রয় নিয়ে। এখানে আপাতত: তৃতীয় পক্ষের দৃশ্যমান কিছু পাওয়া যায়নি। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর বিস্তার দৃশ্যমান হতে পারে।
এখানে মৌলিক আদর্শ হচ্ছে পরিবার। প্রাথমিক শিক্ষাগার যদি পরিবার হয় তাহলে শিক্ষক কারা? শিক্ষকতো তারাই হলেন যারা ঐ পরিবারগুলোর কর্তা বা কর্ত্রী। যে দু’পরিবারের কথা এখানে আলোচনায় এসেছে তাহলে পরিবারের শিক্ষক হিসেবে তাদের অবস্থান অনৈতিকতায় বন্দী।
আজকে মাদকের ব্যবহার বাড়ছে, সমাজ অপরাধ বাড়ছে, সমান মর্যাদার স্থান নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে শুদ্ধ ও সুস্থ পরিবারগুলো আতংকে পড়েছে। পাশের পরিবারের অশুদ্ধ শিশু শিক্ষার যখন আতংক ছড়ায় তখনতো আর নিরাপত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিজের ঘরেই এখন মানুষ পরবাসির মতোই। যে কিশোর সবার আদরে বড় হওয়ার কথা সেই কিশোর এখন এলাকার বড় ভাইদের অনৈতিক আদেশ নির্দেশ পালনে ব্যস্ত। সন্ধ্যার পরই যে শিশু কিশোরের ঘরে ফেরার কথা সে ফেরে অনেক রাত করে। এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন
১. এখন কিশোর অপরাধিরা পিতা-মাতা এবং শিক্ষকদের চাইতে দলের বা এলাকার বড় ভাইদের নির্দেশ বেশি মেনে চলে।
২. অল্প বয়সী শিশু কিশোরদের হাতে দামি মোবাইল, দামি বাইসাইকেল দেখা যায়, পিতা-মাতা কি সে উৎস খুঁজে নেন?
৩. তাদের অর্থের উৎস কোথায়, তাদের বন্ধ করা, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কি করেছে পরিবার কি সে তথ্য নিয়েছেন?
৪. দামি প্যান্ট, দামি শার্ট, দামি ঘড়ি, দামি মানি ব্যাগের উৎস জানা উচিত নয় কি?
পরিবার এবং ঘর থেকে শিশু কিশোরদের এই তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করবেন না। ফলে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। অন্যদিকে অতি স্নেহের কারণে কিছু সংখ্যক মা, দাদী পরিবারের শিশু কিশোরদের অপরাধের কথাগুলো স্বামী বা সন্তানের নিকট গোপন করে রাখেন। এতে করে সন্তান প্রশ্রয় পায়, শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেনা। যেসব পরিবার তাদের সন্তানের প্রতি নিয়মিত আদর, সোহাগ দিয়ে তদারকি করেন সে পরিবারের সন্তানরা নষ্ট হতে পারেন না। এমন পরিবারের সন্তানরা যখন বুঝেন বাবার আদর, মায়ের স্নেহ এবং পরিবারের প্রতিজনের অবস্থান নৈতিক তখন সন্তান পেয়ে যান পথের দিশা। আরো কিছু কিশোরদের উদাহরণ উপস্থাপন করা যায় অনেক পরিবারের বাবা-মা পুরোদিন বাইরে থাকেন, সন্তানের খবর রাখেন না। সন্তানরা আদর পান না, তারা খাওয়ার টেবিলে পিতা-মাতাকে খুঁজে পায়না। এমন পরিবারের সদস্যরাতো বিদ্রোহী হবেই। তারা তখন আনন্দের জন্য পথে নেমে পড়ে এবং পথভ্রষ্ট হয়ে বনে যায় সমাজ অপরাধি। এজন্য দায়ী কে?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগামীকাল শহীদ নূর হোসেন দিবস
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে