ব্যস্ততম চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহরের চিরিঙ্গায় যানজট নিরসনকল্পে বিদ্যমান বক্স সড়কটির দুই পাশে পাঁচ ফুট করে প্রশস্তকরণের (বর্ধিতকরণ) কাজ চলমান রয়েছে। পৌরশহরের জনতা মার্কেট থেকে থানা রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের এই প্রশস্তকরণ কাজের বিপরীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা; যা অবিশ্বাস্য এবং এই কাজটি আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ের লুটপাটের প্রকল্প হিসেবে বলা হচ্ছে সচেতন মহলের পক্ষ থেকে।
অভিযোগ উঠেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত বিপুল অংকের বিপরীতে এই কাজটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। দিনের আলোতে নয়, রাতের আঁধারে জনগণের কোলাহল এড়িয়ে যেনতেনভাবে ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে সড়কটির দুই পাশে প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি দেয়াল নির্মাণের কাজ। নিম্ন মানের মরিচা ধরা পুরোনো রড, সিমেন্ট, মাতামুহুরী নদীর মাটি মিশ্রিত বালু ও স্থানীয় পাথর ব্যবহারের মাধ্যমে রাতের আঁধারেই ঢালাই দেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষা দেয়ালের। রিকশা, টমটমের মত ছোট গাড়ির ছোঁয়া লাগলেই ভেঙে যাচ্ছে সেই দেয়াল। এতে এই কাজের স্থায়ীত্ব নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চকরিয়ার সহসভাপতি জিয়া উদ্দিন জিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, চকরিয়া পৌরশহরের চিরিঙ্গা মহাসড়কে যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে মূলত লুটপাট করার জন্য এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই। সামান্য এই কাজের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা একেবারে অবিশ্বাস্য। সরকারের এত টাকা ব্যয়ের পরও কেন এই নিম্নমানের কাজ করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যমান সড়কটির দুই পাশে পাঁচ ফুট করে প্রশস্তকরণের জন্য ইতোমধ্যে রাতের আঁধারে ঢালাই দেওয়া প্রতিরক্ষা দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে মরিচা ধরা পুরোনো রড, মাতামুহুরী নদীর মাটি মিশ্রিত ময়লা বালু, স্থানীয় পাথর ও নিম্নমানের সিমেন্ট। এতে এই কাজের স্থায়ীত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এমনকি নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়ালে সামান্য আঘাত লাগলেই খসে পড়ছে ঢালাই। আর খসে পড়া ঢালাইয়ের টুকরো হাতে নিয়ে চাপ দিলেই নিমিষেই ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই কাজ টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে ঢালাই করা প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী সিলেটি পাথর, সিলেটি বালুসহ উন্নতমানের উপকরণ দিয়ে নতুন করে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার লুটপাটের এই প্রকল্পে সরকারি টাকার জলাঞ্জলি হবে।
চকরিয়া পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ও পৌরসভা যুবদলের সভাপতি শহীদুল ইসলাম ফোরকান ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, চকরিয়া পৌরশহরে হাইওয়ে রোডের দুই পাশে পাঁচ ফুট করে যে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। রাত ১২টার সময় কিসের কাজ করছে জানি না? এখানে একদম নিম্নমানের পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজগুলো যাতে মানুষের চোখে না পড়ে সেজন্য রাত ১২টার পর শ্রমিক দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদার। যেখানে সড়ক বিভাগের কেউই উপস্থিত নেই। এমতাবস্থায় আমি প্রশাসনের প্রতি পৌরবাসীর পক্ষ হয়ে এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজার কর্তৃক বাস্তবায়িত এই কাজের বিপরীতে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয় পটিয়ার নিপা এন্টারপ্রাইজকে। অবশ্য নিপা এন্টারপ্রাইজ কাজটি বাস্তবায়নের জন্য সাব ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে সাহাব উদ্দিন নামের অপর ঠিকাদারকে। যার বাড়ি চকরিয়া পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাজীরপাড়ায়। মূলত কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরীর বাড়িও পটিয়ায়। এতে নির্বাহী প্রকৌশলী, চকরিয়ার উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী রাহাত আলম এবং সংশ্লিষ্ট উপ–সহকারী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামের যোগসাজশে সাব ঠিকাদার সাহাব উদ্দিন স্থানীয় হওয়ার দাপটে নিম্নমাণের উপকরণ দিয়ে রাতের আঁধারে এই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। যেখানে সওজের কোনো কর্মকর্তার তদারকি নেই বললেই চলে।
নিম্নমানের কাজের ব্যাপারে সরকারের অন্য একটি দপ্তরের প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, পৌরশহর চিরিঙ্গার বিদ্যমান বর্তমান বক্স সড়কটিকে দুই পাশে প্রতিরক্ষা দিয়ে রয়েছে পুরোনো আরসিসি দেয়াল। সেই পুরোনো আরসিসি দেয়াল এবং সদ্য নির্মিত দেয়ালে একটি লোহার বস্তু দিয়ে আঘাত করলেই বেরিয়ে আসবে এই কাজের মান এবং স্থায়ীত্ব। ওই প্রকৌশলী বলেন, বেশি দূরে তো আর যেতে হবে না, মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্বের মধ্যেই প্রমাণ করা যাবে নতুন নির্মিত প্রতিরক্ষামূলক আরসিসি দেয়ালের গুণগত মান নিয়ে।
কাজ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী কার্যালয়ের উপ–সহকারী প্রকৌশলী (এসও) সাইফুল ইসলাম ঠিকাদার ঠিকঠাক কাজ করছে উল্লেখ করে বলেন, সাব ঠিকাদার হিসেবে ভালোভাবে কাজ বাস্তবায়ন করছেন এ জে ট্রেডার্সের মালিক সাহাব উদ্দিন। তবে রাতের আঁধারে কাজ চালানোসহ সার্বক্ষণিক কাজের তদারকি না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চকরিয়া উপশহর চিরিঙ্গা বেশ ব্যস্ত একটি শহর। এখানে দিনে কাজ করার সুযোগ খুব একটা নেই। জনভোগান্তি এড়িয়ে কাজ ঠিকঠাক এগিয়ে নিতে তাই রাতের নিরিবিলি সময়কেই বেছে নেয়া হয়েছে।
অপরদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া কার্যালয়ের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. রাহাত আলমের কাছে এই কাজের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়া হলে বলেন, তথ্য নিতে হলে আবেদন করতে হবে। এর বাইরে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। নিম্নমানের পুরোনো রড, মাতামুহুরী নদীর মাটি মিশ্রিত ময়লা বালু ও স্থানীয় পাথর ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ক্ষুব্ধ হন রাহাত আলম। অবশ্য তার ভাষ্য, যেসব সামগ্রী দিয়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে সেসব সামগ্রীর উপকরণ আগেভাগে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। অতএব এনিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে। সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মিত দুই পাশের প্রতিরক্ষা দেয়ালের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আজাদীকে বলেন, পৌরশহরের যানজট নিরসনকল্পে হাতে নেওয়া এই প্রকল্পটির কাজ যাতে টেকসইভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরও যদি ঠিকাদার নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন এবং তা প্রমাণিত হয় তাহলে নতুন নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেঙে নতুন করে নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হবে।