আজ যে শিশু
পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তরে
একটি সাজানো বাগান চাই।।
আজ যে শিশু
মায়ের হাসিতে হেসেছে
আমরা চিরদিন
সেই হাসি দেখতে চাই।।
যখনই গানটা শুনি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসহায় শিশুদের মুখ। এই মুখগুলো অপরিচিত কেউ নয়। আমাদের চারপাশেই আছে।
গত মাসেই হঠাৎই “আজ যে শিশু” গানটি ফেসবুকে বিভিন্নজনে পোস্ট করেন। এর কারণ হতে পারে–শিশু নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন। জনমত গঠন। সচেতনতা তৈরি। মানুষ এই গানটিকেই বেছে নিয়েছে। বড় ভালো লাগার গানটি যখন মানুষের অন্তরে বেজে ওঠে–তখনই বিবেক জাগ্রত হয়। আজ যে শিশু–গানটির ক্ষেত্রেও তাই হলো। যে হারে শিশু ধর্ষণ, নিপীড়ন বাড়ছিল আশংকাজনক হারে, মানুষের বিবেককে নাড়াতে এই গান ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক তো এখন শক্তিশালী গণমাধ্যম।
আমরাও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য সোচ্চার হই। যে যার অবস্থান থেকে।
এই গানটি ১৯৮৭ সালে লিখেছেন বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। সুর করেছেন শাহবাজ খান পিলু। গেয়েছেনও তিনি। পরে ১৯৯৩ সালে রেনেসাঁ ব্যাণ্ড তাদের “তৃতীয় বিশ্ব” নামে অডিও ক্যাসেটে রিলিজ করে গানটি। ব্যাপক সমাদৃত হয় গানটি। আশির দশক থেকেই বাংলাদেশের ব্যাণ্ড মিউজিকে বক্তব্যধর্মী গানের ধারা চালু হয়ে যায়। আর এই ধরনের গানের ধারা চালু করলেন গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রেললাইনের পাশে নয়
অন্ধকার সিঁড়িতেও নয়
প্রতিটি শিশু মানুষ হোক
আলোর ঝর্ণাধারায়
শিশুর আনন্দমেলায়
স্বর্গ নেমে আসুক।।
একবার ঈদের অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় উপস্থাপক প্রয়াত আনিসুল হক ব্যতিক্রমী গানের অনুষ্ঠান করেন। সেই অনুষ্ঠানে কলীম শরাফী যখন তাঁর দরদী কণ্ঠে “আজ যে শিশু” গানটি গাইলেন, সাথে অন্য বরেণ্য শিল্পীরাও তাঁর সাথে গাইলেন, তখনই মনে হলো–গানটি আসলেই সকল শিশুদের জন্য চাওয়া–পাওয়ার গান। নিরাপদ নিশ্চিত জীবনের গান।
গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী চট্টগ্রামের সন্তান। তিনি একসময়ে ঢাকাবাসী হলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে আসতেন ওমর গনি এম.ই.এস কলেজে অধ্যাপনা করতে। ট্রেনে আসা–যাওয়া করতেন। আর ভোরের আলোয় দেখতেন রেললাইনের পাশে মায়ের কোলে কিংবা কোন ভবনের বারান্দায়, পথের পাশে শুইয়ে আছে শিশুরা। এমন দৃশ্য আমরাও দেখেছি। কিন্তু আমাদের দেখা আর একজন গীতিকবির দেখার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। পৃথিবীর আলোয় আসা শিশুদের নিয়ে গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী লিখে ফেললেন এই গানটি।
পথের পাশে বেড়ে ওঠা শিশুদের জীবন অনিশ্চিত। নানানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। যেটা কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়। শিশুদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এই দায়িত্ববোধ ও সচেতনতাবোধ তৈরিতে এগিয়ে আসে ইউনিসেফ। এই সংস্থাটি “আজ যে শিশু” গানটি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সচেতনতা বোধ তৈরির প্রচারণায় জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রে গানটি গাওয়া হচ্ছে। এ এক বিশাল অর্জন আমাদের জন্য। বাংলাদেশের জন্য।
গানটির সুরকার ও মূল গায়ক শাহবাজ খান পিলু বলেন, গানটির কথা নিয়ে যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো আমাদের দেশে শিশুদের নিয়ে এমন সমৃদ্ধ ও অর্থপূর্ণ কথায় একমাত্র গান। গানের কথা খুবই সহজ। কিন্তু গভীর। অনেক বার্তা বহন করে–যা সর্বজনীন। সবার কাছে আবেদনময়। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাগানো” গানটির পর “আজ যে শিশু” গানটিই দ্বিতীয় গান, যে গানটি বিশ্বময় গাওয়া হচ্ছে। সববয়সী শ্রোতাদের কাছে হৃদয়স্পর্শী আবেদন রেখেছে।”
দেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী ও সুরকার, রেনেসাঁ ব্যান্ডের দলপতি নকীব খান বলেন: “শিশুদের নিয়ে এমন গান এত ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ায় আমাদের জন্য তা গৌরবের। আমি সবসময় বলে থাকি: একটি গানের খুৎরপধষ ঠধষঁবং যত বেশি সমৃদ্ধ, সেই গান ততই সমাদৃত হবে। সেই সাথে সুর। গানের কথা ও সুরের মেলবন্ধন যত মজবুত হবে, গানটি ততই সাড়া জাগাবে। শ্রোতাদের কাছেও দারুণ উপভোগ্য হবে। রেনেসাঁ–র সেরা দশটির গানের মধ্যে ‘আজ যে শিশু’ গানটিকে আমি প্রথমেই রাখবো।”
আজকের প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী মোসলেহ চৌধুরী পিজু বলেন: “এই গানটি একটি ভালোবাসা। একটি অনুপ্রেরণা। বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, এই গানটিও ততদিন থাকবে।”
লেখক শেখ রানার দৃষ্টিতে: “এই গানের কথা–সুর–সংগীত আয়োজন– গায়কী সবকিছুতেই মায়া জড়িয়ে আছে। সে কারণেই হয়তো গানটি সর্বজনীন হয়েছে। বাংলা গানের ইতিহাসে এই গান কখনোই মুছে যাবে না”। আসলেই তাই।
আটত্রিশ বছর আগের লেখা গান আজও জনপ্রিয় এবং কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বলেন: “এই গানের সুরের কোনো তুলনা নেই। অসাধারণ সুর করেছে পিলু খান। হৃদয় মোচড় দেয়া সুর।”
আসুন, আমরা শিশু নিপীড়ন–নির্যাতনে সোচ্চার হই। শিশুদের নিরাপদ ও সুন্দর জীবন গড়তে যে যার অবস্থান থেকে কাজ করি। আজকের শিশু বেড়ে উঠুক অনাবিল আনন্দের মাঝে।
হাসি আর গানে ভরে যাক
সব শিশুর অন্তর
প্রতিটি শিশু ফুলেল হোক
সবার ভালোবাসায়।