সমাজে শ্রেণি-বৈষম্য ও দারিদ্র্য বেড়ে গেলে নানা রকম সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ বৃদ্ধি পায়। এ সবের একটি হলো যৌনাচারে নিয়ন্ত্রণহীনতা। ধনী-গরিবে বিভক্ত সমাজে এ নিয়ন্ত্রণহীনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়করা সমাজবিধান,রাষ্ট্রবিধান ইত্যাদি তৈরি করে গেছেন।
সোলন, প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে অমরত্ব লাভকারী খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধের সময়কার এথেন্সের শাসক। অন্ধকার যুগের প্রসার লাভের আগ-পর্যন্ত শিক্ষিত সমাজে মহাজ্ঞানী হিসেবে যে সাতজন মহামানবের নাম অতি শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হতো তাদের একজন হলেন সোলন। তিনি এখনো প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে পাঠ গ্রহণকারীদের নিকট সমান নমস্য ও প্রয়োজনীয়। তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি হলো এথেন্সের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কার। এর বাইরেও তিনি সমাজে যৌন-অনাচার নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে একটি নজিরবিহীন চরিত্রের অসাধারণ সামাজিক- অর্থনৈতিক কর্মপন্থা উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করেছিলেন। মূলত এ কর্মপন্থাও ছিলো তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কারেরই অংশ। গ্রিকদের মতো দাসভিত্তিক যৌনকাতর সমাজে তাঁর গৃহীত এ কর্মপন্থা তাদের নৈতিক অনুভূতির সাথেও সংগতিপূর্ণ ছিল। সোলনের অমরত্ব লাভকারী এ কর্মপন্থার আলোচনা চিন্তা-চেতনায় পশ্চাৎপদ আমাদের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর পাঠ্যসূচিতে বা এর বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায়-প্রকাশনায় দেখা যায় না।
শোষণমূলক সমাজে যৌন-অনাচারে শৃংখলা যথাসাধ্য সহনশীল পর্যায়ে রাখতে তাঁর প্রবর্তিত কর্মপন্থা-তুল্য বিকল্প বা উন্নত কোনো কর্মপন্থা, শিক্ষায়-চিন্তায়-উদ্ভাবনে- সৃষ্টিতে-মেধায়-মননে অতি উন্নত আধুনিক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পক্ষেও আজও উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় নি। তাই তারা এ সমস্যার সমাধানে সোলন প্রবর্তিত কর্মপন্থাকে এখনো মান্য ও অনুসরণ করে চলেছে।
এথেন্সের শাসনক্ষমতায় সোলনের আগমনের আগে থেকে এথেন্সের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছিল। এ সমস্যার প্রেক্ষাপটেই সোলনের শাসন ক্ষমতায় আগমন এবং এ সমস্যার মীমাংসাকল্পে তাঁর স্মরণীয় ও শিক্ষ্যনীয় ঐতিহাসিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কার। বৃহৎ ভূমি-মালিক অভিজাত ভূস্বামীদের শোষণের ফলে জমির বেশিরভাগ ক্ষুদ্র মালিক সুদে,ঋণভারে নিঃস্ব হয়ে নিজেদের ভূমি হারিয়ে অভিজাত ভূস্বামীদের ভূমি-দাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এথেন্সের অনেক স্থানে দেখা দিয়েছিল এ ভূমিদাসদের বিদ্রোহ। দরিদ্র দাসদের পাশাপাশি দরিদ্র স্বাধীন-নাগরিকদের উদ্ভব হওয়ায় সামাজিক দারিদ্র্য চরম আকার ধারণ করেছিল। অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অন্যান্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকটের পাশাপাশি এথেন্স শহরে দেখা দিয়েছিল নিয়ন্ত্রণহীন যৌন-অনাচার।
এ যৌন-অনাচার নিয়ন্ত্রণে যে কর্মপন্থা তিনি গ্রহণ করেছিলেন সে কর্মপন্থার অসাধারণ সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা দাস-সমাজভিত্তিক অর্থনৈতিক সংকট ও বাস্তবতা থেকে উদ্ভব হয়েছিল, যা এ কর্মপন্থার ভবিষ্যৎ ফলাফল থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যৌন-শ্রমিকদের জন্যে নির্দিষ্ট যৌন-পল্লী প্রতিষ্ঠা করে যৌন-পেশাকে অন্যান্য পেশার মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দান করেন। প্রত্যেক যৌন-শ্রমিকের জন্যে রাষ্ট্রীয় অনুমতিপত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক, সহজ ও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তাদের পারিশ্রমিকও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। প্রত্যেক যৌন শ্রমিককে নির্দিষ্ট হারে যৌন-শুল্ক প্রদান করতে হতো।
তাঁর এ নজিরবিহীন-অদৃষ্টপূর্ব-অভাবিত কর্মপন্থা বাস্তবায়নের ফলে রাতারাতি শত শত দরিদ্র পরিবারের যুবতি মেয়েদের রাষ্ট্রস্বীকৃত-বৈধ কর্মসংস্থান যেমন হয়ে যায়, তেমনি প্রাচীন বিশ্বের প্রধানতম বন্দর নগরী এথেন্সের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এথেন্স নাবিক ও পর্যটকদের জন্যে মহা বিনোদনস্থানে পরিণত হয়। যৌন-বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এথেন্সের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অচিরেই এথেন্সে এ পেশার বিস্তার ঘটতে যেমন শুরু করে তেমনি অনেক নারী যৌন- শ্রমিকের স্বাধীন যৌন-ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এথেন্সে ধনিক-শ্রেণির প্রত্যেক নাগরিককে রাষ্ট্র-নির্ধারিত হারে রাষ্ট্রের জন্যে অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতে হতো। ধনী যৌন-শ্রমিকরাও বিশাল বিশাল রাষ্ট্রীয় স্থাপনা নির্মাণে উদার হস্তে দান করত।
আমরা সকলেই জানি এথেন্সে যে দু’টি পক্ষ, অনেক ব্যতিক্রমী নজির থাকা সত্বেও, সবচাইতে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত হতো তাদের প্রথমটি হলো দাসশ্রেণি এবং দ্বিতীয়টি হলো শ্রেণি-নির্বিশেষে নারী সমাজ। আর এ নির্যাতনকারী ব্যতিক্রমহীনভাবে সব সময় হতো তাদের জীবন ও দেহের মালিক পুরুষ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো; এথেন্সের যৌন-শ্রমিকরা জীবিকার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট পুরুষের ওপর নির্ভরশীল না থাকায় তারা এ নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল। কেন না এথন্সের আইন অনুসারে যৌন-শ্রমিকদের অভিভাবক হতে পারত নারী যৌন-শ্রমিক। অধিকন্তু, কালক্রমে এ ব্যবসা পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন-শ্রমিকদের অভিভাবক হতো তাদের জননী। আমাদের সময়ে সামাজিক যৌনতা ও নগ্নতাকে অনেক দেশে ও সমাজে যে বিবর্জিত-নাজায়েজ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয় তা প্রাচীন গ্রিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কল্পনাতীতভাবে ভিন্নরকমের। তাদের কাছে বাইবেল বা বাইবেল-পরবর্তী কোনো কিতাব ছিল না। তাদের পুরাণে ছিল না স্বর্গে নগ্নতায় আদম-হাওয়ার লজ্জা উপলব্ধির মতো কোনো গল্প। এ কারণে গ্রিকরা নর-নারীর নগ্নতার সৌন্দর্যকে লজ্জার আবরণ থেকে উন্মোচিত করে দেখতে অসংকোচ বোধ করতো না। বিস্ময় জাগানিয়া দক্ষতায় তাদের শিল্পী ও ভাস্কররা মানবরূপী তাদের দেব-দেবীর দেহ-লালিত্যকে চিত্রে, ভাস্কর্যে গোলাপ-নগ্নতার শোভায় মণ্ডিত করে নির্মাণ করে গেছেন। যৌনতা ও নগ্নতা নিয়ে গ্রিকদের এ রকম উদার জীবনবোধের কারণে গ্রিক-সমাজে যৌন-শ্রমিকদের মাথা নিচু করে দেয়ার কোনো সংস্কৃতি বা চিন্তার উপস্থিতি ছিল না।
প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে হাত গোনা যে কয়েকজন সামাজিক নারী অমরত্ব লাভ করেছেন এদের মধ্যে চারজন অভিজাত শ্রেণির যৌন-শ্রমিক। যে যৌন-শ্রমিকদের এ উপমহাদেশের ধারণা অনুযায়ী রাজ-গণিকা বা বাঈজি বলা হয়ে থাকে। অবশ্য এখানকার ধারণা এবং এসব নামকরণ গ্রিসের অভিজাত যৌন-শ্রমিকদের পরিচয় বোঝানোর জন্যে যথেষ্ট নয়।
গ্রিসের শিল্প, ললিতকলা ও দর্শন চর্চায় এদের ভূমিকা ছিল অংশগ্রহণমূলক, প্রেরণাদায়ক ও অপরিহার্য। এদের অনেকেই ছিলেন আধুনিকালের বিশ্বসুন্দরীদের মতো অনেক গুণে গুণান্বিত ও উচ্চ শিক্ষিত। রাজনীতির ক্ষেত্রও বাদ দেয়া যায় না। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠতম যুগের শ্রেষ্ঠতম শাসক পেরিক্লিসের জীবন-সঙ্গিনী, অংঢ়ধংরধ ছিলেন একজন অভিজাত যৌন-শ্রমিক। তিনি ছিলেন পেরিক্লিসের প্রধান রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন শিক্ষক, সুবক্তা ও কবি। শুধু তাই নয়, এই মহিয়সী নারীর সৌন্দর্য ও জ্ঞান-সুধা পান করার জন্যে প্রায় সন্ধ্যায় এথেন্সে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ভিড় করতেন সক্রেটিস,প্ল্যাটো,এরিস্টটল,এনাঙাগোরাসসহ তাঁর সময়কার দার্শনিকগণ। অমরত্ব লাভকারী এসব দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও রচনায় এ নারীর সান্নিধ্য ও চিন্তাধারার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।
আমরা সোলনের সময় থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পরবর্তী কালের মানুষ। বিবর্তনবাদের নিয়মে সোলনের সময় থেকে মানবসমাজ এবং মানুষের চিন্তাধারা উন্নত থেকে আরো উন্নততর হয়েছে। আমাদের সময়, অতীত হয়ে যাওয়া হাজার হাজার মনীষী, দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক ও বিজ্ঞানীর সংগ্রাম ও সাধনালব্ধ অতি উন্নত জ্ঞানভাণ্ডার দ্বারা সুসমৃদ্ধ। আমরা নিশ্চয়ই সমাজ-মানুষের দারিদ্র্য ও যৌন-অনাচার নিয়ন্ত্রণে রাখার বা বন্ধের জন্যে সোলনের সমাধানকে আজকের দিনে যথোপযুক্ত কর্মপন্থা বলে মেনে নিতে পারি না। কারণ সমাজে দারিদ্র্য ও যৌন-অনাচার উচ্ছেদের জন্যে পতিতাবৃত্তির প্রচলন বা টিকিয়ে রাখার কর্মপন্থা কোনো আদর্শ সমাধান হতে পারে না। যদিও গ্রিকরা যৌন-শ্রম ও যৌন-শ্রমিকদের, অনেক পশ্চাৎপদ সমাজের মতো, ঘৃণা ও ধিক্কারের বিষদৃষ্টি দিয়ে দেখতো না, তথাপি প্রাচীন গ্রিসের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ যৌন-শ্রমিক চরম দারিদ্রে-পিষ্ট হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করত। নিত্য অভাব ও দারিদ্র্য মানুষকে মানুষ হতে দেয় না। জীবনের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে না পারলে মানুষ নিজেকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। আজকে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ-ভাবনার প্রধান লক্ষ্য হলো ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও এ প্রগতিশীল সমাজভাবনার ধারক ছিলেন। শুধু তাই নয়, এ উপ মহাদেশে তিনিই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতাকে দারিদ্র্যের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানবতার শত্রুদের হাতে গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের চাইতেও করুণভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
তাঁর রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’-এর মনোযোগী পাঠক হতে পারলে মাও সে-তুঙের কম্যুনিস্ট এবং বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক সমাজ-ভাবনার সঙ্গী হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। যৌন-অনাচারকে মাও সে-তুং এবং চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজের প্রধান বা মৌলিক কোনো সমস্যা হিসেবে দেখেন নি, দেখেন নি পৃথক কোনো সমস্যা হিসেবে। সমাজের আর দশটা সমস্যার মতো তাঁরা সমাজের অর্থনীতি এবং অর্থনীতিজাত শিক্ষা-সংস্কৃতিকেই এ সমস্যার উৎসস্থল হিসেবে দেখেছেন। আমরা দেখতে পাব তাঁদের এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার কী বিস্ময়কর মিল রয়েছে! পরবর্তী কালে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী নয়াচীনের অর্থনীতি ও সমাজ নির্মাণের কর্মপন্থাসমূহের পেছনকার দার্শনিক শক্তির সাথে বিন্দু-মাত্রায় পরিচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁরা সমস্যাগুলোকে কীভাবে দেখেছেন?
‘পৃথিবীতে সমস্যাগুলো জটিল, আর তা বিভিন্ন উপাদান দ্বারা নির্ধারিত। বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যাগুলোকে দেখতে হবে, শুধুমাত্র একটা দিক থেকে দেখলে চলবে না।’ সূত্র: সভাপতি মাওসে-তুঙের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ২৪৫।
চীন যৌন-অনাচারের সমাধান কীভাবে করেছে তা জানার আগে সেখানে মাও সে-তুংয়ের সমাজ তান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে চীনের অর্থনৈতিক ও যৌন-সমস্যা কিরকম ছিল তা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই জেনে নেয়া যাক। “চিয়াং কাইশেকের আমলে জমির মালিক জমিদারই ছিল। চাষির জমির উপর কোনো অধিকার ছিল না। চাষিরা ক্ষেতমজুরি করে কোনো মতে জীবন যাপন করতো। চাষের সময় কাজ পেতো অনেকে, আবার বহু লোক পেতোও না। আয় খুব কম ছিল। জমিদাররা ইচ্ছামতো কৃষকদের জমি দিতো, আবার ইচ্ছা হলে কেড়ে নিতো। আইন ছিল বড়লোকদের হাতে।…বছরে বছরে দুর্ভিক্ষ হতো। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। কারণ যা উপার্জন করতো তার চেয়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি, তাই তা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।“ সূত্র: আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান,পৃষ্ঠা-৮৭-৮৮।
যদিও বঙ্গবন্ধু এখন থেকে আটষট্টি বছর আগে ১৯৫২ সালে তাঁর চীন সফর নিয়ে লেখা বইতে চীন এবং পাকিস্তানের যে সমাজবাস্তবতার বিবরণ দিয়েছেন তা এতকাল পরেও পুরানো হয়ে যায়নি বরং তাঁর সে সময়কার চিন্তাধারা এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয়। নয়া চীনে যৌন-অনাচার বন্ধ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন; “আমাদের রাজধানী করাচিতে আইন করে বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু আমি জানি প্রায় সকল হোটেলেই এই ব্যবসা চলে থাকে। আইন করে কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যা না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন।
নয়াচীনে আজকাল পূর্বের মতো মেয়েদের বাবা মায়ের টাকা দিয়া আর জামাই কিনতে হয় না। তাহারা নতুন বিবাহ আইন প্রবর্তন করেছে। ছেলে মেয়ে একমত হয়ে দরখাস্ত করলেই তাদের যার যার ধর্মানুযায়ী বিবাহ দিতে বাধ্য। ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট’ এই পুরানো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে,তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়েছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিয়েছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।…নয়াচীনে মেয়েরা আজকাল জমিতে,ফ্যাক্টরিতে,কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। …যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে।…নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর”। সূত্র: ঐ, পৃষ্ঠা-৯৭,৯৮,৯৯।
নয়াচীনে মাও সে-তুংয়ের সরকার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে কী উপায়ে যৌন-অনাচার বন্ধ করেছে সে অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকেই শোনা যাক। “আমি আমার দোভাষীর মাধ্যমে সাংহাই শান্তি কমিটির নেতার সাথে আলাপ করলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কী করে বেশ্যাবৃত্তি তুলে দিলেন ? তারা বললো: আইন করে তুলে দেন নাই।তবে কি অত্যাচার করে তুলে দিয়েছেন ?” উত্তরে বললেন, “ না, অত্যাচার করেও তুলে দেই নাই। আবার আইন করেও তুলে দেই নাই। আইন করে তুলে দিলে কি হবে, এদের তো বাঁচাতে হবে! এদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করে দিলেই তার পর আইন করা যায়। শুধু আইন করলেই কোনো কাজ হয় না। আমাদের সরকার প্রথমে গণনা করলো কত বেশ্যা চীনদেশে আছে। তার পর তাদের জন্য কিছু কাজের ব্যবস্থা করা হলো। আমরা প্রত্যেক সমাজসেবক প্রথমে তাদের কাছে যেয়ে বোঝাতে লাগলাম, তোমরা এ বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে দাও। তোমাদের কাজের বন্দোবস্ত করে দিতেছি। তোমরা ফ্যাক্টরিতে কাজ করবা অন্য মেয়েরা যেভাবে করে, তারপর যাকে পছন্দ করবা তার যদি মত হয়, তবে তোমাদের বিবাহ হবে, সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। তোমরা সাধারণ মানুষের মতো বাস করতে পারবা। এভাবে জীবন নষ্ট করে তোমাদের লাভ কী? এভাবে দলে দলে কর্মীরা তাদের সাথে দেখা করে আলোচনা করতে শুরু করলো।” সূত্র: ঐ,পৃষ্ঠা-৯৫্ত৯৯। এ ভাবে মাও সে-তুং কর্মসংস্থান ও বাসস্থান সৃষ্টি করে এবং নারী-পুরুষকে আদর্শিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং সম্মানজনক জীবন দান করে চীন থেকে অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতো যৌন অনাচারও বন্ধ করেছিলেন।