আজকের দিনে, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক কেবল বন্ধু–বান্ধবদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি যেমন নতুন সুযোগ এনেছে, তেমনই এর ‘ট্রল সংস্কৃতি‘ বা সাইবার হয়রানি এক নতুন সামাজিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। একুশ শতকের এই ডিজিটাল যুগে এসে, আমরা যেন এক অদৃশ্য মানসিক যুদ্ধের শিকার হচ্ছি।
ট্রল সংস্কৃতি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা নিয়ে হাস্যরস করা বা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করার প্রবণতাকেই সাধারণত ট্রল সংস্কৃতি বলা হয়। প্রথমদিকে এটি সাধারণ বিনোদন হিসেবে শুরু হলেও, এখন তা প্রায়শই সাইবার বুলিং বা মানহানিকর আক্রমণের রূপ নেয়।
সাধারণত সেলিব্রিটি, রাজনীতিবিদ বা সমাজের আলোচিত ব্যক্তিরা এই ট্রলের শিকার হন। কিন্তু এর ভয়াবহ দিক হলো, এখন সাধারণ মানুষও সামান্য ভুল বা ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য গণ–আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
একজন ব্যক্তি যখন অসংখ্য নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক মন্তব্যের শিকার হন, তখন তা তার মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব, এমনকি চরম ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। ট্রলকারীরা প্রায়শই মজা করার অজুহাত দিলেও, এর শিকার হওয়া মানুষটির জন্য তা চরম মানসিক নির্যাতন।
ব্যক্তিগত আক্রমণ বা গোয়েন্দাগিরি করে ট্রল করার সময় ব্যক্তির অতীত তুলে আনা, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে দেওয়া বা পারিবারিক বিষয় টেনে এনে আক্রমণ করার ঘটনা এখন খুব স্বাভাবিক। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সামাজিক, পারিবারিক জীবন ও পেশাগত সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রল সংস্কৃতি এবং সাইবার হয়রানি সরাসরি দেশের সাইবার নিরাপত্তার প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। যখন একজন মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপদ বোধ করেন না, তখন তার মৌলিক অধিকারই লঙ্ঘিত হয়। এটা সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ ও আইনের সীমাবদ্ধতাকে হেয় করা হয়।
অনেক ট্রলই গুজব বা ভুয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এই ভুয়া তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় বড় ধরনের সহিংসতা বা সামপ্রদায়িক উত্তেজনার জন্ম দেয়। যা অহরহ দেখতে পাচ্ছি।
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য সাইবার নিরাপত্তা আইন (পূর্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) রয়েছে। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধের হার কমছে না কেন? প্রমাণের অভাবে সাইবার বুলিং বা ট্রল করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছদ্মনাম (Fake ID) বা ভিপিএন ব্যবহার করে। ফলে অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা এবং আদালতে পর্যাপ্ত ডিজিটাল প্রমাণ পেশ করা তদন্তকারী সংস্থার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আইন থাকলেও, তা কার্যকরভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুতর ফাঁক ও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এই দুর্বলতাগুলিই ট্রল সংস্কৃতি এবং সাইবার হয়রানিকে আরও উৎসাহিত করছে।
আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও ভুক্তভোগীর অনীহার কারণ হলো, সাইবার নিরাপত্তা আইন (পূর্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) এর অধীনে মামলা করা গেলেও, এর প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর।
সাইবার ক্রাইমের তদন্ত করতে গিয়ে সাইবার ফরেনসিক বা ডিজিটাল ডেটা বিশ্লেষণের মতো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। ভুক্তভোগীরা, বিশেষ করে নারী ও তরুণীরা, প্রায়শই সামাজিক মানহানি এবং অতিরিক্ত হয়রানির ভয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে নিরুৎসাহিত হন। সাইবার অপরাধ দমনের দায়িত্ব বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিভক্ত। পুলিশ, সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)-এর মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের অভাবে অনেক সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়।
ট্রল বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মূল মাধ্যম হলো ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলো। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে অপরাধীর তথ্য পেতে দেশীয় তদন্তকারী সংস্থাকে আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্যের গোপনীয়তার নীতি মেনে চলতে গিয়ে দ্রুত তথ্য দিতে চায় না। তথ্যের আদান–প্রদানে জটিলতা আইনি প্রক্রিয়াকে আরও ধীর করে দেয়।
ভুয়া তথ্য প্রায়শই সামপ্রদায়িক উত্তেজনা, জাতিগত সংঘাত বা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়। কোনো স্পর্শকাতর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যা রটনা ছড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়, যা সমাজে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়ানো এই বিষাক্ত বীজ সরাসরি বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলে।
অনেকেই জানেন না যে সাইবার বুলিং একটি গুরুতর অপরাধ এবং এর প্রতিকারের জন্য আইনের আশ্রয় নেওয়া যায়।
এই অন্ধকার দিক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেবল কঠোর আইন নয়, প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি স্তরে মানসিকতার পরিবর্তন। কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তার উৎস যাচাই করা এবং একাধিক বিশ্বস্ত মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া প্রতিটি ডিজিটাল নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এর পাশাপাশি, তথ্য যাচাইকারী সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলোর সম্মিলিতভাবে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য।
স্কুল পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে ভিন্ন মত বা পছন্দকে সম্মান জানানোর সংস্কৃতি তৈরি করা জরুরি। কেউ ভুল করলে তাকে ট্রল না করে গঠনমূলক সমালোচনা বা তথ্য দিয়ে সহায়তা করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ভার্চুয়াল জগৎ যেহেতু আমাদের বাস্তব জীবনেরই অংশ, তাই এই প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার দিক দূর করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। ট্রল নয়, বরং সহানুভূতি ও গঠনমূলক আলোচনা হোক আমাদের ডিজিটাল সমাজের ভিত্তি।
লেখক : প্রাবন্ধিক









