“এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম–গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।” পল্লী কবি জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতায় দাদু যখন দাদিকে তার ঘরে তুলেছিলেন তখন দাদির পুতুলকে বিয়ে দেওয়ার বয়স মাত্র। এ লাইনগুলোতে দাদির বাল্য বিবাহের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার বাল্য বিবাহ নামক ব্যাধিটির যে প্রচলন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর বাড়িতে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ঠাকুর বাড়ির জ্ঞানদা নন্দনী মাত্র সাত বছর বয়সে, কাদম্বরী দেবী নয় বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মাত্র নয় বছরে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন। দিগম্বর দেবী এবং সারদা দেবী মাত্র ছয় বছর বয়সে বিয়ের মাধ্যমে ঠাকুর বাড়িতে পা রাখেন। তৎকালীন সমাজের বাল্য বিয়ে নামক ব্যাধিটি আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও বর্তমান তাই এখনো প্র্রশাসনকে বাল্য বিবাহ বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে।
বহুল পরিচিত আইন দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর খসড়ার কাজ ১৮৩৪ সালে শুরু হয়, যা ব্রিটিশ ভারতের প্রথম আইন কমিশন আরম্ভ করে, যার নেতৃত্ব দেন থমাস ব্যাবিংটন মেকল। উল্লেখ্য তিনি কোন আইনজ্ঞ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক দলের নেতা। তাঁর বিভিন্ন আলোচনা ও লেখায় ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে আইন ও প্রশাসন কোর্সের একটি সেশন নিচ্ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক এক কর্মকর্তা। তিনি দন্ডবিধি হতে ব্যাভিচার/পরকীয়ার বিষয়টি পড়াতে গিয়ে বললেন এই অপরাধে জড়িত পুরুষ লোকের শাস্তি হিসেবে ৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে কিন্তু এই অপরাধে জড়িত স্ত্রী লোকটির কোন সাজা হয় না। শুনে তো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অবশ্য পরবর্তীতে স্যারের ব্যাখ্যা শুনে আমরা ধারণা পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। স্যারের ব্যাখ্যাটি ছিল এরকম সে সময় মেয়েদের বিয়ে হতো অনেক কম বয়সে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী পুরুষের সাথে। নারী জীবনে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদা তৈরি হওয়ার পূর্বেই তাদের স্বামীরা হয়তো মারা যান অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যান। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থাকে চপেটাঘাত করার জন্য মেকলের খসড়াতে এই ধারাটির সংযোজন। বাল্য বিয়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সমাজের এ অসামাজিক সমস্যার সূত্রপাত।
প্রায় ৮ বছর পূর্বে আমার এক আত্মীয় তার ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। আমার মা আমাকে জানালেন আমাদের সে আত্মীয়ের মেয়েটির নাকি বিয়ের কথা বার্তা চলছে। আমি আমার আত্মীয়টিকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন, মেয়েটির বাবা প্রবাসে থাকেন এবং তাদের একমাত্র ছেলেটি পটিয়া সরকারি কলেজে পড়ে এবং একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়। মেয়েটি সুন্দর হওয়ায় তার দিকে মানুষের চোখ পড়ে। মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে তিনি তার ছেলের সহযোগিতার জন্য লাঠি যোগাড় করছেন বা পিছনে কিছু লোক সৃষ্টি করছেন। আমি তাকে বললাম যে লাঠি আপনি যোগাড়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সে লাঠির আঘাত তো উল্টো আপনাদের গায়ের উপরও পড়তে পারে। আপনার মেয়ের স্কুলে যেতে সমস্যা হলে আমাদের বাড়িতে রেখে পড়ান আর আপনি যদি মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করেন তবে আমি পটিয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ওসি সাহেবকে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেব। সে যাত্রায় মেয়েটির বিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল এবং বর্তমানে মেয়েটি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ৫ম সেমিস্টারে পড়ছে। তার বড় ভাইটি বর্তমানে প্রবাসে ভাল অবস্থায় আছে। বাল্য বিবাহ দেওয়ার উদ্যোগের শুরুতেই যদি কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে থামানো যায় তবে একজন নারী জীবনব্যাপী নানা সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায়। মেয়েদের নিরাপদ শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে বাল্য বিবাহ অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়।
উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন প্রায় বাল্য বিয়ে সংঘটনের সংবাদগুলো আসত শুক্রবার জুমার নামাজের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। সংবাদ পাওয়ার পর একটি মোবাইল কোর্টের প্রস্তুতি নিতে অনেক সময় লেগে যেত। গাড়ির ড্রাইভারকে বাসা থেকে এনে গাড়ি বের করা, পেশকারকে সংবাদ দিয়ে আনা, থানায় যোগাযোগ করে ফোর্সের ব্যবস্থা করা এবং একজন অফিস সহায়ককে হাজির করা ইত্যাদি কাজগুলো সম্পন্ন করে মোবাইল কোর্টের উদ্দেশ্যে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতাম। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখি খাবার–দাবার রান্না শেষ, বর যাত্রীরা চলে এসেছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে বরযাত্রীরা খেতে বসে পড়েছেন, কেউ কেউ পরের ব্যাচে বসে খাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে বর এসেছেন বা তার আসাটা শুধু বাকি, এমনও হয় ম্যাজিস্ট্রেট হানা দেয়ার খবরে বর আর বিয়ের আসরেও আসলেন না। বিয়ে বাড়িতে দেখা যায় অনেক জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ দুই পক্ষের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত। মোটামুটি বিব্রতকর একটি অবস্থা। এ অবস্থায় কি আর সাজা দেব? কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে সাজা দিতে হয়েছে অথবা জনপ্রতিনিধিদের জিম্মায় বিয়ে বন্ধ করতে হয়েছে। বিয়ের কিছু দিন পর হয়তো খবর পেতাম ঐ উপজেলার বাইরে কোথাও নিয়ে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিয়ে আপাত ঠেকানো গেলেও চূড়ান্তভাবে খুব কম ক্ষেত্রেই বন্ধ করা যায়।
২০১৮ সালের শেষের দিকে নোয়াখালীর একটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করার সময় মাননীয় সংসদ সদস্যসহ সকল জনপ্রতিনিধি, শিক্ষকমণ্ডলী, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিক, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে উপজেলাটিকে “বাল্য বিবাহ মুক্ত উপজেলা” ঘোষণা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গিয়েছিল, উপজেলা প্রশাসন মাত্র ৫ মাস সময়ের মধ্যে প্রায় ১৯ টি বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যেই দেশে কোভিড–১৯ মহামারী শুরুর কারণে আমাদের এ উদ্যোগটি অনেকটা স্থবির হয়ে যায়। অবশ্য পরে জেনেছি বন্ধ করা এ বিয়েগুলোর মধ্যেও অনেকগুলো নানাভাবে পুনরায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। এরপরও সবাইকে সম্পৃক্ত করার কারণে বাল্য বিয়ের সংবাদগুলো অন্তত বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনের কিছুটা পূর্বে পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে স্কুল খোলার দিনে যদি কোন বাল্য বিয়ে হতো ঐ মেয়ের সহপাঠীরা একসাথে কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল অনেক বার। একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের কর্মকান্ডসমূহ সরকারি আইন–কানুন, বিধি–বিধান দ্বারা পরিচালিত হয় তাই এর বাইরে গিয়ে এ ধরনের কাজ করা আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। অধিকন্তু ঐ সময়কাল পর্যন্ত বর্তমান বাল্য বিবাহ নিরোধ বিধিমালা, ২০১৮ আমরা হাতে পাইনি। যেহেতেু এটি একটি সামাজিক আন্দোলন তাই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে বাল্য বিবাহ বিরোধী আন্দোলনটি হলে আরো ভাল হয় এবং সেক্ষেত্রে প্রশাসন সহায়তা করতে পারে।
বাল্য বিবাহের মত সামাজিক ব্যাধিমুক্ত সমাজ গঠন প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি রোধ করা যেতে পারে। বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এবং বাল্য বিবাহ নিরোধ বিধিমালা, ২০১৮ এর আওতায় বর্তমানে সরকার বাল্য বিবাহ বন্ধে সুনিপুণ একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। এ বিধিমালার আওতায় ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে যেখানে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেক হোল্ডারদের সমন্বয়ের সব ধরনের সুযোগ রয়েছে। এ আইন ও বিধিমালার মধ্যে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা প্রত্যেকে যদি জীবনে কমপক্ষে একটি বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে পারি এবং সকল বাল্য বিয়ে বয়কট করি তবে হয়তো বাল্য বিবাহের ব্যাধিমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব হবে।
লেখক : নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম