সমপ্রতি দেশে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সকলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এরা খুন হয়েছে। আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যেহেতু আমাদের পরিবারগুলো সমাজেরই অংশ, তাই এখানে সহিংসতার প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘বিরোধ বাবার সঙ্গে, আছাড় মেরে ৬ বছরের ছেলেকে হত্যা’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সন্দ্বীপে এক ব্যক্তির সাথে বিরোধের জেরে তার ৬ বছরের শিশুকে আছাড় মেরে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বুধবার সকাল ১১টার দিকে উপজেলার মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পেলিশ্যার বাজার এলাকায় এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমকে (৪৫) আটক করেছে সন্দ্বীপ থানা। নিহত শিশুর নাম আলী হোসেন। সে স্থানীয় বাশারুল উলুম মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং মগধরা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু তাহেরের ছেলে। শুভ রানী নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি বাজার থেকে আসার সময় দেখেন রাস্তার মধ্যে শিশু আলীর কোমর ধরে পর পর তিনবার আছাড় মারেন জাহাঙ্গীর। পারিবারিক বিরোধের জের ধরে শিশুটি মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর আলম তার ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এতে আলীর মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে এবং মুখ ও কান দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। তখন শুভ রানী চিৎকার চেঁচামেচি করে আশপাশের লোকজন ডাকেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয়রা শিশুটিকে সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গেলে চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তবে সন্দ্বীপ চ্যানেল পার হওয়ার আগেই শিশুটির মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক মূল্যবোধ দায়ী। তাঁরা বলেন, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, যৌতুক, মাদক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব কাজ করছে। পরিবারে শারীরিক–মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এ কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও যান না। ফলে মানসিক সমস্যা ও সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। তবে পরিতাপের বিষয়, সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সংঘটিত সহিংসতার সঠিক চিত্রটি অজানা, যা অনভিপ্রেত।’ তাঁদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি। আইন থাকলেও অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা থানা–আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। বেশির ভাগ ঘটনাই স্থানীয় সালিসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু এই সমঝোতার বৈঠকেও ঘটলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই সহিংসতা আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর ফল। এর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। আর এটি করতে না পারা মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।
গবেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার পেছনে ব্যক্তি পর্যায়ে অস্থিরতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় যেসব মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলো মেনে চললে ব্যক্তি কিংবা পরিবার–এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। অপরাধ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়–এসবের জন্য বেশি দায়ী ঐতিহ্যগত শিষ্টাচারগুলোকে অবজ্ঞা করা। মোটকথা, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে দরকার সুস্থ পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মেলবন্ধন।
বলা যেতে পারে, সামগ্রিক অসহিষ্ণুতার কারণেই পারিবারিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আকাশ–সংস্কৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অযাচিত ব্যবহারও অন্যতম একটি কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ বিষয়ে সরকারসহ আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এ নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সর্বোপরি বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।