সেদিন গ্রাম থেকে শহরে আসার পথে দেখলাম– কাঁঠাল ভর্তি একটা সিএনজি টেক্সি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এত কাঁঠাল কোথায় নিচ্ছেন?’ জানালেন, বোনের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন, বোনের নতুন বিয়ে হয়েছে, তাই কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠাল নিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম আমের মৌসুমে আম, তরমুজের মৌসুমে তরমুজও নিয়ে গেছেন। কথাটা বলার সময় তার মনে এক ধরনের চাপা কষ্ট। কষ্টটা যতটুকু বুঝলাম এক ধরনের আর্থিক দৈন্য থেকে। কিন্তু সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে এবার এগুলো কর্জ করেই তাকে দিতে হচ্ছে। এই সময়ে তা দিতে না পারলে যেন তাদের মুখ রক্ষা হয় না। বোনের নতুন বিয়ে দিয়েছেন, ফল ছাড়াও অতীতে এরকম আরও অনেক কিছু দেবার কথা বললেন। যেমন, পিঠার মৌসুমে পিঠা, রমজানে ইফতারি, কোরবানিতে ছাগলসহ আরো অনেক কিছু দেবার ফিরিস্তি শোনালেন। অনেক অপ্রয়োজনীয় এসব সামাজিকতার নামে সামান্য কিছুই এখানে বলা হলো। ব্যাপারগুলো এ সমাজে এখন নিছক কল্পনা নয় বরং বাস্তবতা। এক সময় সমাজের বিত্তশালীরা সমাজে সামাজিকতার খাতিরে এসব বীজ বপন করে গিয়েছিলেন এখন তা ধীরে ধীরে সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত–এমনকি তা নিম্নবিত্তের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষরা এসব সংস্কৃতির গোড়াপত্তন ঘটালেও তা আর তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং তা ক্রমাগত এক ধরনের বিষফোঁড়াতে পরিণত হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে এ সংস্কৃতির প্রভাব চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি। আর চট্টগ্রামে কনে বিয়ে দেওয়া মানে মেয়ের বাপের ওপর বিরাট এক ঝক্কি ঝামেলা যাওয়া। যে ঝামেলা মেয়ের বাপের অর্থবিত্ত কী রকম সেটা মুখ্য হবার চেয়ে তার মানসম্মান রক্ষার্থে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও সামাজিকতার নামে অনেক কিছুই তাকে করতেই যেন এক ধরনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা। চট্টগ্রামের বিয়েতে বরের পক্ষের যত বেশি লোক আনা যায় তাতে যেন প্রেস্টিজ বাড়ে অনেকের। একজন কনের পিতা স্বাভাবিকভাবে কনেকে প্রতিষ্ঠিত করে দিলেও অনেক বরের পক্ষ যেন কোনো দিক দিয়ে ছাড় দিতে নারাজ। শুধু বিয়ে নয়, বিয়ের পরবর্তী আরও অনেক অনুষ্ঠানমালার ধকল কিন্তু মেয়ের বাপের ওপর দিয়েই যায়। বিয়েতে তীর্থের কাকের মত বসে থাকা উপহার নেবার ব্যক্তিদের উপস্থিতিও এক ধরনের অস্বস্তিকর। অনেকের বিয়েতে আবার উপহার নগদ টাকা নেবার মতও পরিস্থিতি দেখা মেলে। বিষয়গুলো বর্তমান আধুনিক সমাজে ভীষণ দৃষ্টিকটু। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে হয় নিদিষ্ট তারিখ অনুযায়ী। এটাকে লুফে নেন কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবসায়ীরা। সারাবছর কোন কোন তারিখে বিয়ে আছে তা তারা ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখেন। এটা তাদের রীতিমত মুখস্থ হয়ে যায়। অনেক আগে থেকে এরকম তারিখে কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দেয়া হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে তারা তিন চারগুন ভাড়া হাঁকিয়ে বসে। অনেক ক্লাবে কয়েকটি বিয়েও হতে দেখা যায়। এ চাপটাও কনের বাবাকে সামলাতে হয়। বিয়ের পর কনের বাপের ওপর আরও আনুষ্ঠানিকতার ধকল যায়। বতর্মান সমাজ ব্যবস্থায় এখন বিষয়গুলো মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানীং সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট তারিখে মন্দির বিয়ের প্রবণতা লক্ষণীয়। নির্দিষ্ট তারিখে মন্দিরে বিয়ে সম্পন্ন করে অন্য একদিন কোনো কমিউনিটি সেন্টারে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। এতে কমিউনিটি সেন্টারের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় রোধ বা তাদের দৌরাত্ম্য রোধ কিছুটা সম্ভব হচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। এভাবে কিছু সংস্কারে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এখন নিজের পরিবার পরিজনের দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা মেটাতে গিয়ে এক ধরনের করুণ অবস্থা। তার ওপরে এই তথাকথিত দেয়া–নেয়ার সামাজিকতার নামে বা মুখ রক্ষার নামে এ কাজগুলো অসহ্য হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ না পারছে কিছু করতে না পারছে কিছু বলতে। এ নিয়ে সমাজে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির লোকদের পাশাপাশি সকলেরই এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা রয়েছে। ধীরে ধীরে সামাজিকতা রক্ষার নামে এসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো দূরে সরিয়ে দেবার দিন এসেছে। বেশি বেশি লোক এনে ব্যয় করিয়ে জৌলুস দেখানোর মাঝে কোনো মহত্ত্ব নেই। এসব লোক দেখানো আভিজাত্য থেকে বিত্তবানরা সরে আসলে সবাই ধীরে ধীরে এ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হবে। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এসব অপ্রয়োজনীয় কিছু তথাকথিত সামাজিকতার নামে যা হচ্ছে তাতে মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোক ফতুর হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সামাজিকতার ধরন পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বায়নের এ যুগে ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ডামাডোলের যুগে মানুষের জীবন যাপনের ধরন পাল্টে যাবার স্রোতে মানুষের সামাজিকতার দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টানো দরকার। সেই পুরানো দৃষ্টিভঙ্গির স্রোতের সাথে কেউ কেউ মোটেও এখন তাল মেলাতে পারছে না। সামাজিকতা রক্ষার নামে এসব কিছু করতে গিয়ে সমাজে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বা নিজেকে ছোট ভাবার প্রবণতা দৃশ্যমান। ক্ষমতা, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা অর্থবিত্ত ধনী গরিবের ব্যবধানের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের চিরচেনা সাম্য, ঐক্য, শৃঙ্খলা, শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ। সামাজিক ঐক্যে ফাটল ধরে সমাজ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পারষ্পরিক দূরত্ব। মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা আজ সমাজের বুকে কঠিন বাস্তবতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাওয়া আর অভিনয় করা যেন কিছু মানুষ। সমাজের অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, বিভিন্ন সামাজিকতা পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া এ মানুষগুলোর অবস্থান বড়ই নাজুক। সামাজিকতা করতে গিয়ে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কিন্তু সামাজিকতার নামে অতি আড়ম্বতা কাম্য নয়– যা উদাহরণ হিসাবে নিয়ে অনেকে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবার প্রয়াসী হন এবং তা ধীরে ধীরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখানো হয়, গ্রাম ছেড়ে শহর কিংবা এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে স্থানান্তরের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ হিসাবে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের বহিঃপ্রকাশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই কষ্টে সামিল হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও ঔষধপত্রের খরচ, যোগাযোগ খরচ বেড়ে যাওয়াসহ নানামুখী সামাজিক ব্যয় মেটানোর অক্ষমতা। এই চাপগুলো বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষকে সংকটে ফেলেছে সবচাইতে বেশি। আমাদের ভাবতে হবে আমরা মানুষ, মনুষ্যত্বই আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর সামাজিকতা তো আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পারষ্পরিক বন্ধনের এক অনবদ্য অলংকার। এখানে বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার নামে অনাকাঙ্ক্ষিত সব অনাচার বন্ধ করতে হবে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত প্রত্যেকেই নিয়েই তো সমাজ। প্রত্যেককে প্রত্যেকের স্থান থেকে অবদান রাখতে হবে। যেখানে কোনো কিছু দেয়া নেয়ার মাধ্যমেই সেই সর্ম্পকের ভিত রচিত হতে পারে না। নতুন প্রজন্মকে একটি নির্মল–শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেয়ার কাজটি করার জন্য সকলেরই একটি পরিশীলিত ভাবনায় অবদান রাখা চাই। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির এই কঠিনতম সময়ে সবাইকে এ নিয়ে ভাবতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।