জুলাই–আগস্টের আন্দোলন দমনে পরিকল্পনা ও নৃশংসতাসহ বিগত বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন বেআইনি কর্মকাণ্ড এবং নির্বাচনে জালিয়াতির বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে তুলে ধরেছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। যিনি আসামি থেকে এখন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়েছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার তিনি বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল–১–এ জবানবন্দি দেন। খবর বাংলানিউজের।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন বলেন, ২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। র্যাবের মহাপরিচালক হওয়ার কারণে আমি জানি টিএফআই সেল র্যাবের সদর দফতরের অধীনে পরিচালিত হতো। এছাড়াও র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটগুলোর অধীনে আলাদা আলাদা সেল ও বন্দিশালা ছিল। ওইগুলো সংশ্লিষ্ট ইউনিট প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো। র্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র্যাবের ভেতরে একটি কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন।
তিনি বলেন, র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনার বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যার করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময়ে আমি এই ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পেরেছি। র্যাব যদিও পুলিশের আইজিপির অধীনে ছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। আমি যতদিন র্যাব মহাপরিচালক ছিলাম, চেষ্টা করেছি সিরিয়াস বিষয়গুলো আইজিপিকে অবহিত করতে।
গত বছর জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের বিষয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির সরকারি বাসায় কোর কমিটির মিটিং হতো। সেখানে আন্দোলন দমনের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ জানানো হতো এবং নির্দেশনা দেওয়া হতো। কোর কমিটির সদস্য হিসেবে আমি ছাড়াও সচিব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান ও গোয়ন্দা সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।
ডিজিএফআই সমন্বয়কদের আটকের প্রস্তাব দেয় জানিয়ে চৌধুরী মামুন বলেন, কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। আমি বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিলে আমি রাজি হই। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিজিএফআই এবং ডিবি যৌথভাবে তাদের আটক করে ডিবিতে নিয়ে আসে। ডিবি হেফাজতে নিয়ে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার বিষয়ে চাপ দেওয়া হয়। তাদের আত্মীয় স্বজনদেরও ডিবিতে নিয়ে আসা হয়। আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতেও সমন্বয়কদের বাধ্য করা হয়। এ বিষয়ে ডিবিপ্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডিবিপ্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জিন বলে ডাকতেন। কারণ হারুন সরকারের নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিলেন।
আন্দোলনে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের বিষয়ে জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, আন্দোলনের এক পর্যায়ে হেলিকপ্টার এবং ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি এবং গুলি করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার ছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন ডিজি ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ। পরবর্তীতে আন্দোলন দমনে সরকার লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করে এবং আন্দোলন প্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ব্লক রেইড করার সিদ্ধান্ত হয়।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামাসন খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। যখন ফোন করেছিলেন, আমি তখন পুলিশ হেডকোয়াটর্সে আমার অফিসে ছিলাম। আমার সামনে তখন অতিরিক্ত আইজিপি প্রলয় জোয়াদ্দার উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় জোয়াদ্দারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা জানালে সে রুম থেকে বের হয়ে ডিএমপিসহ সারা দেশে এই নির্দেশনা পৌঁছে দেয়। ১৮ জুলাই এই নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকেই লেথাল উইপেন ব্যবহার শুরু হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশনা দেন। লেথাল উইপেন ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিব ও ডিবিপ্রধান হারুন।
সাবেক আইজিপি বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানাক, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, মির্জা আজম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, প্রধানমন্ত্রীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করেন। ড্রোন, হেলিকপ্টার, লেথাল উইপেন ব্যবহার করে অসংখ্য ছাত্র–জনতাকে আহত ও নিহত করা হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী ছাড়াও সরকারকে আন্দোলন দমনে উৎসাহিত করে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীরা।
নিজের দোষ স্বীকার করে সাবেক আইজিপি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে তাদের আহত ও নিহত করায় আমি সাবেক পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাই আন্দোলনে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এই জন্য অপরাধবোধ এবং বিবেকের তারণায় আমি অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোদের কান্না–আহাজারি আমি শুনেছি। ভিডিওতে যে নৃশংসতা দেখেছি, এতে মনে হয়েছে অ্যাপ্রুভার হওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত ও স্তম্ভিত করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি চাকরি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। আমার এই চাকরিজীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি সব সময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে, তার দায় আমি স্বীকার করছি।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। তিনি বলেন, আমি গণহত্যার শিকার প্রত্যেকের পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকিটা জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।