নগরীর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের ১৭ কোটি ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকার সম্পদের হদিস পাওয়া গেছে দুদকের অনুসন্ধানে। এরমধ্যে তার গ্রহণযোগ্য সম্পদ মাত্র ১ কোটি ২৬ লাখ ৪৬ হাজার ১৪ টাকার। যা তিনি অতীত সঞ্চয়, ব্যবসা, গৃহ সম্পত্তির আয়, স্ত্রী থেকে পাওয়া উপহার আর সম্মানী ভাতা থেকে পেয়েছেন। বাদবাকী ১৬ কোটি ১৮ লাখ ২৯ হাজার ১৮৬ টাকার সম্পদ তিনি অসাধু উপায়ে অর্জন করেছেন। মাছ ব্যবসা থেকে আয় করেছেন, ডেইরী ব্যবসা থেকে আয় করেছেন, জমি অধিগ্রহণ থেকে আয় এসেছে, এমনকি সিকিউরিটিজ সুদসহ অন্যান্য উৎস থেকে হওয়া আয় থেকে বিপুল অংকের উক্ত সম্পদ অর্জনের কথা বলা হলেও দুদকের অনুসন্ধান বলছে, যেসব খাত থেকে আয়ের কথা বলা হচ্ছে সেসব আয়ের স্বপক্ষে কোনো রেকর্ডপত্র কিংবা কাগজপত্র দেখাতে পারেন নি সুমন।
শুধু সুমন নয়, তার স্ত্রী শাহানাজ আকতারেরও বড় অংকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের হদিস পেয়েছে দুদক। শাহানাজ আকতারের সবমিলে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৭৮ হাজার ২৬৯ টাকার সম্পদ রয়েছে। এরমধ্যে তার গ্রহণযোগ্য সম্পদ ৬৬ লাখ ৫২ হাজার টাকার। যা তিনি ব্যবসা ও ডেইরী ব্যবসা থেকে আয় করেছেন। বাদবাকী ২ কোটি ২ লাখ ২৬ হাজার ২৬৯ টাকার সম্পদ তিনি স্বামী সুমনের অসাধু উপায়ে অর্জিত অর্থে গড়েছেন।
২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৩৯ নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সুমন ও তার স্ত্রী শাহানাজ আকতারের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করেছে দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর উপসহকারী পরিচালক আপেল মাহমুদ বিপ্লব এ দম্পতির বিরুদ্ধে কমিশন বরাবর অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এতে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলার সুপারিশ করা হয়। উক্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে সুমন ও তার স্ত্রী শাহানাজ আকতারের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
২০০৯ সাল থেকে হালিশহর, ইপিজেড, পতেঙ্গা, কক্সবাজারে সম্পদ গড়ে আসা সুমন আওয়ামী সরকার পতন পরবর্তী তথা গত বছরের ৫ আগস্টের পরও নিজ নামে স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের এক জায়গায় দেখা যায়, সুমন গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর নগরীর পতেঙ্গা থানাধীন মধ্য হালিশহর মৌজার ৬০০ শতাংশ জমি আমমোক্তারনামা দলিলমূলে অর্জন করেছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুমন কাউন্সিলর হওয়ার আগে শুধু মধ্য হালিশহর মৌজায় পুকুরপাড়সহ সাড়ে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি নাল জমি ও দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় সাড়ে ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি ভিটি ভূমি অর্জন করেছিলেন।

আর কাউন্সিলর হওয়ার পর ইপিজেডের আবদুল মাবুদ সওদাগর রোডের ব্যারিস্টার কলেজ এলাকায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের একটি ৮ তলা ভবনের অর্ধেক (কাউন্সিলর সুমন সাহেবের বাড়ি), দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা মূল্যের ভিটিভূমি, মধ্য হালিশহর মৌজায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ভিটিভূমি, দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের নাল জমি, একই মৌজায় ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের পৃথক দুটি নাল জমি, কঙবাজার সদর ঝিলংজা পৌর এলাকা মৌজায় ৬৪ লাখ টাকা মূল্যের ৪ দশমিক ৯৬ শতক জমি, উক্ত জমির উপর (কলাতলীতে অবস্থিত) নির্মিত ৮ তলা ভবনে থাকা হোটেল সেন্ডসিটি’তে সাড়ে ৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ, দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় ৫২ লাখ টাকার একটি পুকুর, দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজায় সাড়ে ২২ লাখ টাকার নাল জমি, দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় ২৮ লাখ টাকার পৃথক দুটি পুকুর একই মৌজায় ১৭ লাখ টাকার ভিটি ভূমি, ১৫ লাখ টাকার নাল জমি, সাড়ে ৩০ লাখ টাকার পুকুরসহ ভিটি ভূমি, মধ্য হালিশহর মৌজায় ৩৫ লাখ টাকার পৃথক দুটি নাল জমি ও পাকা গৃহ, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরে নির্মিত ১৫০০ বর্গফুট বিশিষ্ট প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ৬ তলা ভবন, দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৫ টাকার ৫৮ শতাংশ নাল জমি, হালিশহরের বড়পুল এলাকায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা মূল্যের ২৬১০ বর্গফুটের ৬ তলা ভবন ও পতেঙ্গা থানাধীন মধ্য হালিশহর মৌজায় ৬০০ শতাংশ জমি তথা স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে মোট ১৫ কোটি ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫০ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছেন সুমন। কিন্তু যাচাই করলে দেখা যায়, মোট ১৫ কোটি ৭৩ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯২ টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক তিনি। এক্ষেত্রে তিনি ৫৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬৫ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানকালে সুমনের নামে চট্টগ্রাম জেলা সদর সাবরেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত মোট ১১ টি বায়নানামা দলিলের তথ্য পাওয়া গেছে। এসবে তিনি ১ কোটি ৮৯ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
সুমনের অস্থাবর সম্পদ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আসবাপত্র, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, গাড়ী, একটি শটগান এবং ব্যাংক এশিয়ান কেপিজেড শাখার হিসাবসহ তিনি মোট ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু যাচাই করলে দেখা যায়, তিনি ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫০৬ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক।
এক্ষেত্রে তিনি ২৫ হাজার ৫০৬ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুমন ২০২১–২২ কর বছরে আয়কর নথিতে ব্যবসার মূলধন ৩২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৯ টাকা, ডেইরী ব্যবসার মূলধন ৯৫ লাখ টাকা ও মৎস্য ব্যবসার মূলধন ১ লাখ টাকা প্রদর্শন করেন। মূলত অবৈধ আয়কে বৈধ করার জন্যই তিনি উক্ত অর্থ মূলধন হিসেবে দেখিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে সুমন মোট ৫৪ লাখ ৯ হাজার ৭১ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
দুদকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সুমনের স্ত্রী শাহানাজ আকতারের স্থাবর সম্পদের বিষয়ে বলা হয়েছে– ২০১৯ সালে তিনি দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজায় সাড়ে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ১০.২৫ শতক নাল জমি, ২০১৭ সালে দক্ষিণ হালিশহর মৌজায় ১ কোটিরও বেশি টাকা মূল্যের ১২০০ শতাংশ জমি ও ২০১৮ সালে একই মৌজায় ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের ৩৩৩ শতাংশ জমি অর্জন করেছেন। সবমিলে তিনি মোট ১ কোটি ৮৯ লাখ ১৪ হাজার ৯৬০ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি তিনটি গাড়ি ও স্বর্ণ মিলে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সুমন পড়াশোনা তেমন করেননি। তিনি মাত্র এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তার স্ত্রী শাহানাজও এইচএসসি পাস।
আদালতসূত্র জানায়, অনুসন্ধান চলাকালীন গত ২৪ জুন দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে নগরীর হালিশহর, পতেঙ্গা এবং কলাতলির হোটেল সেন্ড সিটিসহ কঙবাজারে থাকা সাবেক কাউন্সিলর সুমন ও তার স্ত্রীর ১১ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ৯১০ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের (জব্দ) নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. হাসানুল ইসলাম। বিক্রি, হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাতের আশংকা থেকে দুদকের পক্ষ থেকে উক্ত সম্পদ ক্রোক চেয়ে আবেদনটি করা হয়।
দুদক পিপি মোকাররম হোসেন দৈনিক আজাদীকে এ বিষয়ে বলেছেন, অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এখন কমিশনের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের অনুমোদন দিলে দুদক চট্টগ্রাম তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে।












