সাফল্যের গল্প বললেন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত নারীরা

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

মঞ্চ আলোকিত করে বসে মিট মিট করে হাসছিলেন পটিয়া উপজেলার সদ্য নির্বাচনে বিজয়ী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু। আরেকপাশে বসেছিলেন আনোয়ারা উপজেলা থেকে নির্বাচিত একেবারে নবীন বিজয়ী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান চুমকি চৌধুরী। ছিলেন জুঁইদন্ডী ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস। আর কারিতাসের বিশাল হল জুড়ে যেন সেদিন বসেছিল রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত নারীদের এক মহামিলনমেলা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন্‌ উপজেলা থেকে ছুটে আসা এসব বিজিত নারীরা কীভাবে তৃণমূল থেকে শুরু করে নিজেদেরকে একটি অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন , সেই সাফল্যের গল্পই বলে গেলেন স্ব স্ব অবস্থান থেকে। আর সেই সুযোগটি করে দিয়েছেন খান ফাউন্ডেশন অপরাজিতা নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অপরাজিতাদের সাফল্যের গল্প’। তবে এই অপরাজিতাদের যারা আজ এই অবস্থানে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন খান ফাউন্ডেশনের কর্ণধাররা। এই ফাউন্ডেশন রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণমূলক অগ্রযাত্রা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন অপরাজিতা নেট ওয়ার্কের কার্যক্রম। মূলতঃ ১৯১৮ সাল থেকে এই নেটওয়ার্ক এই লক্ষ্য নিয়ে সারাদেশে কাজ শুরু করেছিল। ৪টি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত প্রকল্পটিতে অন্যতম সহযোগী ছিল বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন সংস্থা সুইজারল্যান্ডের (এসডিসি) ও হেলভেটাস সুইস ইন্টার কোঅপারেশন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় সহযোগী সংস্থা ডেমোক্রেসিওয়াড, খান ফাউন্ডেশন, প্রিপ ট্রাস্ট ও রূপান্তর। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় সরকার তথা গভর্নেন্স প্রক্রিয়ায় নারীদের সমান অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব প্রসার এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখা ও নারীর জন্য গৃহিত রাষ্ট্রীয় আইনগুলো নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সারা দেশে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে অপরাজিতা নেটওয়ার্ক দেশের বিভিন্নস্থানে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অপরাজিতা নারীদের তৈরি করেছে তিল তিল করে। দেশের অন্যান্য জেলার মতো চট্টগ্রাম জেলায় ও ফলে আমরা পেয়েছি অনেক অপরাজিতা। এই অপরাজিতারাই তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন সেদিনের সমাপনী অনুষ্ঠানে। সমাপনী অনুষ্ঠান মানে এই কয়েক বছর ধরে যে প্রকল্পের অধীনে অপরাজিতাদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো, সেই প্রকল্প এই মাসেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই আয়োজকরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব একেবারে সাধারণ নারীদেরকে অপরাজিতা হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন, তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, অর্জিত অবস্থানকে তুলে ধরার জন্য। একইভাবে বিজিত অপরাজিতারা কীভাবে এই নেটওয়ার্ককে চলমান রাখতে পারেন, সেই বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার জন্য। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনারের উপ পরিচালক শাহীনা সুলতানা। বিশেষ অতিথি ছিলেন মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসার কামরুন মোয়াজ্জেম, সমাজসেবা কর্মকর্তা কামরুল পাশা। শেয়ারিং অনুষ্ঠানে অপরাজিতারা তাদের সংগ্রামের গল্প শোনান। বেশিরভাগ অপরাজিতা খান ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এই সংগঠন আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমাদেরকে এগিয়ে যাবার সাহস যুগিয়েছেন, কথা বলা শিখিয়েছেন, আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো কি সেসব বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন। এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে তারা রাজনৈতিকভাবে কিভাবে নিজেদেরকে ক্ষমতায়িত করেছেন সেই গল্প বললেন। আবার নানান সমস্যা ও সংকটের কথাও এসেছে তাদের গল্পে। অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ প্রত্যেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। উনারা উনাদের স্ব স্ব অফিসের নারীদের গৃহিত সরকারি সেবাগুলো কি কি, এবং কিভাবে সেবাগুলো নিতে হবে তা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। বিশেষ করে কৃষি অফিসারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও চমৎকার উপস্থাপনায় আমি নিজেই মুগ্ধ হয়েছি। সরকার প্রান্তিক কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নে কত ব্যবস্থা না রেখেছেন, নিরাপদ বীজ ও সুষম খাদ্য উৎপাদনে কত কত প্রক্রিয়া রয়েছে, এমনকি নারী কৃষকদের জন্যও রয়েছে নানামুখী সুবিধা। অথচ নারীরা কেউই জানেন না, তাদের হাতের কাছে, অর্থাৎ প্রতিটি প্রান্তিক নারীর স্ব স্ব উপজেলায় রয়েছে এই সব সরকারি সেবাগুলো। অনুষ্ঠানে অপরাজিতা এসে নিজেদের কর্মকান্ড তুলে ধরার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ড এবং সুবিধাগুলো সম্পর্কেও একটি স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে গেলেন। আর বিজিত এসব নারীরা এই নেটওয়ার্ককে যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। খান ফাউন্ডেশন যেভাবে তাদেরকে হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করবেন, তা আজ তারা শিখে গেছেন। সমাপনী অনুষ্ঠানেই অপরাজিতাদের বক্তব্যে তার প্রমাণ মেলে। সার্থক খান ফাউন্ডেশন। সার্থক অপরাজিতা নেটওয়ার্ক। এতোদিন ধরে প্রায় ৯ হাজার তৃণমূল প্রান্তিক নারী নেত্রীদের নিয়ে কাজ করে আসছে এই সংস্থাটি। এই সংস্থাটির প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী ছিল প্রান্তিক নারীরা। আর পরোক্ষভাবে যারা কাজ করে গিয়েছেন তারা অধিকাংশই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক বর্তমান বা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।

এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯ হাজার তৃণমূল নারী যারা নিজেদের অপরাজিতা বলে পরিচয় দেন অধিকতর আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার সাথে এবং দৃশ্যমান নেতৃবৃন্দের ভূমিকায় ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের সাথে যোগ দেয়া অন্যান্য নারী জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ক বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রামে অপরাজিতা কর্ম এলাকায় ১১ জন নারী চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন। সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হার দেশের অন্যান্য নারীদের তুলনায় ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ( আরপিও) অনুসারে রাজনৈতিক দল সমূহের সকল কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩% নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিতে অপরাজিতা অভাবনীয় সাফল্যের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকশ রাজনৈতিক নেতানেত্রীকে (অধিকাংশই পুরুষ) সংলাপে যুক্ত করেছেন। অপরাজিতার কর্ম এলাকায় বাল্য বিবাহের পাশাপাশি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে ব্যাপক কাজ করেছেন। এসব অর্জনগুলোর কারণেই সেদিন বেশিরভাগ অপরাজিতা সমস্বরে যেন উচ্চারণ করলেন, অপরাজিতা আমাদের রাজনীতি শিখিয়েছে, আমাদের ঘরের থেকে বের হতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। আমরা এখন পারিবারিক ও সামাজিক বাধা ডিঙ্গিয়ে প্রত্যেকে স্বাবলম্বী এবং আত্মনির্ভরশীল। ফলে অপরাজিতার কার্যক্রম শেষ হলেও প্রযুক্তির কারণে যে আন্তঃযোগাযোগ রচিত হয়েছে, তা চলমান রাখবেই সাহসী ও অদম্য অপরাজিতারাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবি
পরবর্তী নিবন্ধনাঙ্গেলি, এক বিদ্রোহীর নাম