সাতকানিয়ায় অসময়ে তরমুজ চাষ করে বাজিমাত করেছেন কৃষকরা। বর্ষা ও শরৎকালে উচ্চ ফলনশীল তরমুজ চাষ করে অল্প সময়ে এবং কম খরচে দ্বিগুণ–তিনগুণ লাভ করছে কৃষকরা। তরমুজ চাষ করে ছদাহা এলাকার কিছু কৃষক ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অসময়ে তরমুজ চাষের কথা শুনে ক্ষেত দেখতে ভিড় করছেন আশপাশের এলাকার কৃষক ও উৎসুক মানুষ। স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভ হওয়ায় বছরের পর বছর বাড়ছে তরমুজ চাষ। মালচিং ও মাচাং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে কৃষকরা সফলতা পাওয়ায় অন্যান্য কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে বর্ষা ও শরৎকালীন তরমুজ চাষ নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। আগামীতে তরমুজ চাষের স্বপ্ন বুনছে অনেক কৃষক। অধিক লাভ হওয়ায় বারোমাসি তরমুজ চাষে এলাকার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ।
ছদাহা ইউনিয়নের খোর্দ কেঁওচিয়া ব্লকের উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আয়ুব আলী জানান, ২০১৯ সালে এনএফএলসিসি প্রকল্পের আওতায় পূর্ব ছদাহা এলাকায় প্রথম শরৎকালীন তরমুজ চাষ শুরু করা হয়। পূর্ব ছদাহা মাঝের পাড়ার কৃষক আবুল ফয়েজ সরকারি প্রণোদনায় ১ কানি জমিতে গোল্ডেন ক্রাউন ও ব্ল্যাকবেবি জাতের উচ্চফলনশীল তরমুজ চাষ শুরু করে। প্রথম বছরই খুব ভাল ফলন হয়। এরপর থেকে এলাকার অন্যান্য কৃষকরাও তরমুজ চাষ শুরু করে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ছদাহা ইউনিয়নের খোর্দ কেঁওচিয়া ব্লকের পূর্ব ও দক্ষিণ ছদাহা এলাকার বিলে মালচিং ও মাচাং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করেছে। বিলে অন্যান্য মৌসুমী শাক–সবজির সাথে তরমুজ ক্ষেতও রয়েছে। মাচাংয়ের উপর শোভা পাচ্ছে তরমুজের সবুজ সতেজ লতা পাতা ও কচি তরমুজ। মাচাংয়ের নিচে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ডোরাকাটা পরিপক্ব তরমুজ। কৃষকরা মনের সুখে তরমুজ ক্ষেতের পরিচর্যা করছে। মাচাংয়ের নিচে ছিঁড়ার উপযোগী তরমুজ দেখে আনন্দে মেতে উঠছে কৃষকের মন। এলাকার বিলগুলোতে পাকিজা, মার্সেলো, তৃপ্তি, ব্ল্যাকবেবি ও গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজ চাষ করা হয়। কৃষকরা জানিয়েছেন, এসব জাতের তরমুজ বর্ষাকালে চাষ করা যায়।
দক্ষিণ ছদাহা বিল্লিয়া পাড়ার কৃষক আবুল হাশেম জানান, আমি বিগত ৬ বছর ধরে বর্ষা ও শরৎকালে তরমুজ চাষ করে আসছি। প্রথম বছর ৩ কানি জমিতে চাষ করেছিলাম। জমির খাজনা, মালচিং ও মাচাং তৈরি, বীজ রোপণ থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত শ্রমিকসহ মোট ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। ফলন ভাল হওয়ায় প্রথম বছরই ৪ লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর বর্ষা ও শরৎকালে তরমুজ চাষ করে আসছি। বারোমাসি তরমুজে বীজ রোপণের পর থেকে মাত্র ৬০–৬৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। ফলে একই মালচিং ও মাচাংয়ের মধ্যে দুই দফায় তরমুজ চাষ করা যায়। এতে করে খরচও কিছুটা কমে আসে। আবুল হাশেম জানান, এবছর আমি সাড়ে ৫ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। এরমধ্যে ১৮ গন্ডা জমির তরমুজ ইতিমধ্যে বিক্রি করেছি। ওই ১৮ গন্ডা জমিতে তরমুজ চাষ করতে আমার ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। সেখান থেকে ইতিমধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। আরো ৩০–৪০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারব। সব মিলিয়ে ১৮ গন্ডায় খরচের চেয়ে তিনগুণ বেশি লাভ হবে। অন্যান্য ক্ষেতগুলোও ভাল হয়েছে। কিছু জমিতে তরমুজ এখন ২০০–৩০০ গ্রাম সাইজের হয়েছে। এগুলো আগামী ২০–২৫ দিন পর বিক্রি করতে পারব। বাকি জমিগুলোতে এখন তরমুজের ফুল আসতে শুরু করেছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় তরমুজ চাষে লাভ বেশি। ফলে আগামী বছর থেকে তরমুজ চাষ আরো বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে।
পূূর্ব ছদাহা মাঝের পাড়ার কৃষক আবুল ফয়েজ জানান, বিগত ৭ বছর আগে কৃষি বিভাগের পরামর্শে আমিই এলাকায় প্রথম বারোমাসি তরমুজ চাষ শুরু করি। প্রথম বছর ১ কানি জমিতে ব্ল্যাকবেবি ও গোল্ডন ক্রাউন জাতের তরমুজের চাষ করি। প্রথম বছরই খুব ভাল ফলন হওয়ায় ২ লাখ টাকা লাভ হয়। ওই বছর প্রতি কেজি তরমুজ ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। এরপর থেকে প্রতিবছর ১ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করি। একই মালচিং ও মাচাংয়ে আমরা দুই বার তরমুজ চাষ করি। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির কারনে খেতের ক্ষতি হয়ে লাভ কিছুটা কম হলেও শরৎকালে উৎপাদন খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লাভ হয়। এবছরও ১ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। এখন ফুল–ফল আসতে শুরু করেছে। আশা করছি ভাল লাভ হবে। তিনি জানান, এখন এলাকার অনেক কৃষক তরমুজ চাষ শুরু করেছে। কম সময়ে অধিক লাভ হওয়ায় তরমুজ চাষ বছরের পর বছর বাড়ছে।
দক্ষিণ ছদাহা বিল্লিয়া পাড়ার কৃষক আমির হোসেন জানান, আমি ৬ বছর ধরে বর্ষা ও শরৎকালে তরমুজ চাষ করে আসছি। প্রতি বছরই উৎপাদন খরচের চেয়ে দ্বিগুণ–তিনগুণ লাভ হয়েছে। এবছর ৪ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। তরমুজ ধরা শুরু হয়েছে। ফল সংগ্রহ করতে আরো ৩৫–৪০ দিন লাগবে। এবারেও ভাল লাভ হবে ইনশাআল্লাহ। গ্রীষ্মকালীন তরমুজ বিক্রি হয় পিস হিসেবে। বর্ষা ও শরৎকালীন তরমুজ বিক্রি হয় কেজি হিসেবে। ফলে ভাল লাভ পাওয়া যায়।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, ছদাহার খোর্দ কেঁওচিয়া ব্লকে ৫ হেক্টর জমিতে বর্ষা ও শরৎকালীন তরমুজ চাষ হয়েছে। ২০১৯ সালে এনএফএলসিসি প্রকল্পের আওতায় সরকারি প্রণোদনায় প্রথম বর্ষা ও শরৎকালীন তরমুজ চাষ শুরু হয়। প্রথম বছর থেকে ভাল ফলন হওয়ায় এবং অধিক লাভ পাওয়ায় কৃষকরা তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অসময়ে তরমুজ চাষ করে কৃষকরা উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে দ্বিগুণ–তিনগুণ লাভ পাচ্ছে। ফলে তরমুজ চাষ বছরের পর বছর বাড়ছে। ছদাহা ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বর্ষা ও শরৎকালে মালচিং ও মাচাং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করা সম্ভব। এতে করে কৃষকরা অধিক লাভবান হবে। এজন্য আমরা কৃষকদেরকে তরমুজ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।