সাতকানিয়ায় তিন ফসলি জমিতে তামাক চাষ

চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া | রবিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

সাতকানিয়ায় তিন ফসলি জমিতে এখন বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ করছে কৃষকরা। অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে। তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় প্রস্তাবে কৃষকরা এখন রবিশস্যের চেয়ে তামাক চাষে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কক্সবাজারের চকরিয়া ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের কিছু কৃষক সাতকানিয়ায় এসে খাজনা দিয়ে জমি নিয়ে তামাক চাষ করছে। তাদের দেখাদেখি এলাকার অনেক কৃষক এখন তামাক চাষ শুরু করেছে। কয়েক বছর আগে আলু, মরিচ, শীম, বেগুনসহ যেসব জমিতে রবিশস্য ও মৌসুমী শাকসবজি চাষ করা হতে সেই জমিগুলো এখন তামাকের দখলে। তামাক চাষের পরিধি বছরের পর বছর বাড়ছে। বিশেষ করে বাজালিয়ার মাহালিয়া, ছদাহার শহীদের নালা, হরিণতোয়া ও কেঁওচিয়ার তেমুহনী এলাকায় তিন ফসলি জমির বুকে এখন বিষ ছড়াচ্ছে তামাক। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ জমির মালিকরা অধিক টাকার লোভে বোরো ও মৌসুমী শাকসবজি চাষীদের পরিবর্তে তামাক চাষীদেরকে জমি দিচ্ছে। ফলে অন্যান্য ফসলে আগ্রহ হারাচ্ছে এলাকার কৃষকরা। এদিকে, এসব এলাকায় উৎপাদিত তামাক শোধন প্রক্রিয়ার জন্য স্থাপন করা হয়েছে চুল্লি। তামাক চুল্লিগুলোতে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। তামাক চুল্লিগুলোতে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মন কাঠ পোড়াচ্ছে। তামক চাষ থেকে শুরু করে শোধন প্রক্রিয়া পর্যন্ত সকল কাজে ব্যবহার করছে শিশু শ্রমিক। তামাক শোধনের জন্য লোকালয়ে চুল্লি স্থাপন করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে এলাকার মানুষ।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রমতে, সাতকানিয়ার ছদাহার হরিণতোয়া, শহীদের নালা, বাজালিয়ার মাহালিয়া ও কেঁওচিয়ার তেমুহনী এলাকায় ৩ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। কিন্তু এলাকার কৃষকরা জানিয়েছে এসব এলাকায় কমপক্ষে ২০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। তামাক চাষ বছরের পর বছর বেড়ে চলছে।

সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, তামাক ভয়াবহ ক্ষতিকর ফসল। উপজেলার ৩টি এলাকায় কয়েক বছর ধরে তামাক চাষ করা হচ্ছে। তামাক চাষ বছরের পর বছর বাড়ছে। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের মাঝে নগদ টাকা ও সার প্রদান করছে। তামাক চাষীদের সন্তানদেরকে কোম্পানিতে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে। নানাভাবে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদেরকে তামাক চাষে আগ্রহী করে তুলছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদেরকে বুঝিয়েছি। যেসব এলাকায় তামাক চাষ হচ্ছে সেই এলাকার সকল কৃষক নিয়ে বড় পরিসরে সচেতনতামূলক সভা করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা কৃষকদের বুঝাতে পারবো। কিন্তু তামাক চাষে সরাসরি বাঁধা দিতে পারছি না। তামাক চাষ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এখন সেই সুযোগ নাই। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি কৃষকদেরকে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনতে।

ছদাহা হরিণতোয়া এলাকার রফিক আহমদ জানান, সাতকানিয়ার শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত মাহালিলা বিলের দক্ষিণাংশ এখন তামাকের দখলে। এছাড়া আশপাশের বিলেও তামাক চাষ করা হচ্ছে। এসব তামাক শোধন প্রক্রিয়ার জন্য মাহালিয়া, শহীদের নালা ও হরিণতোয়া এলাকায় ৩০টির অধিক চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে। এসব তামাক চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। এসব চুল্লিতে কাঠের যোগান দিতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে স্থানীয় বনাঞ্চল। প্রতিদিন প্রকাশ্যে হাজার হাজার মন তামাক চুল্লিতে পোড়ানো হলেও বন কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছে। এলাকার জমির মালিকরাও অধিক হারে খাজনা পাওয়ায় তামাক চাষে উৎসাহ যোগাচ্ছে।

ছদাহা সীন্ধুপ্যা পাড়ার কৃষক শামসুল আলম জানান, আমি মাহালিয়া এলাকায় ২০ কানি জমিতে তামাক চাষ করেছি। জমি চাষ থেকে শুরু করে চুল্লিতে তামাক শোধন প্রক্রিয়া পর্যন্ত সব কাজের জন্য চকরিয়া থেকে লোক নিয়ে এসেছি। এখানকার লোকজন তামাকের এসব কাজ ঠিক ভাবে করতে পারেনা। স্থানীয় ভাবে শ্রমিক না পাওয়ায় খরচ একটু বেশি হয়ে যায়। তামাক চাষে প্রতি কানি জমিতে শোধন প্রক্রিয়াসহ ১ লক্ষ টাকা করে খরচ হয়। এক কানি জমির তামাক বিক্রি করে দেড় লক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। তামাক চাষ করে অল্প সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ লাভ পাওয়া যায় তা অন্য ফসলে সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো তামাক চাষে কোম্পানির পক্ষ থেকে নগদ টাকা, সারসহ নানাভাবে সহায়তা করে থাকে। লাভ কম হলেও লোকসানের সম্ভাবনা নাই।

একই এলাকার কামাল উদ্দিন জানান, আমি ১৮ কানি জমিতে তামাক চাষ করেছি। প্রতি কানিতে এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। দেড় লক্ষ টাকা করে বিক্রি করতে পারবো। এবছর তামাকের পাশাপাশি কিছু জমিতে মরিচ ও বেগুন চাষ করেছি। মরিচ চাষে লোকসান হয়েছে। বেগুন চাষে সামান্য লাভ হয়েছে। আর তামাক চাষে প্রতি কানিতে ৫০ হাজার টাকা করে লাভ হয়েছে। আমি লাভের তামাক ছেড়ে লোকসানের মরিচ, আলু খেত করতে যাবো কেন ? অধিক খাজনার লোভে রবিশস্য চাষীদের পরিবর্তে তামাক চাষীদেরকে জমি দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ছদাহা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোসাদ হোসাইন চৌধুরী জানান, অধিক খাজনার জন্য নয়। হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে। আলু, বেগুন, শীমসহ নানা মৌসুমী সবজিগুলো হাতি এসে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু তামাক খেত নষ্ট করেনা। এজন্য হাতির ভয়ে কৃষকরা অন্যান্য শাকসবজির পরিবর্তে তামাক চাষ করছে। তামাক চাষ ভাল নয়, ক্ষতিকর। আমরাও তামাক চাষের পক্ষে নয়।

তামাক চুল্লিতে বনের কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পদুয়া রেঞ্জের বড়দুয়ারা বন বিট কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তামাকা চাষ এবং চুল্লিতে কাঠ পোড়ানোর বিষয়টি আমার জানা নাই। এখন যেহেতু জানতে পেরেছি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। বনের কাঠ কাটা এবং পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দা সংযমের প্রশিক্ষণ নেয়
পরবর্তী নিবন্ধজালিয়াতি করে ১০ এনআইডি, ৩০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ, অবশেষে ধরা