সাড়ে ৬শ কোটি টাকা উদ্ধারে নতুন অ্যাকশন প্ল্যান

পণ্যের এজেন্টের কাছে বকেয়া থাকা জাহাজ ভাড়া ।। আমদানিকারকদের কাছে জাহাজ মালিকদের কোনো টাকা আটকে নেই

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৯ মার্চ, ২০২৪ at ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের বিবদমান বিভিন্ন গ্রুপ আবারো একই ছাতার নিচে আসার ব্যাপারে প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে একই সিরিয়াল অনুসরণ করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তৎপরতা শুরু করার পর বিবদমান গ্রুপগুলো আবারো একজোট হওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। তবে শেষতক ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে ঠেকছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। অপরদিকে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে জাহাজ মালিকদের আটকে থাকা কয়েকশ’ কোটি টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আমদানিকারকদের কাছে কোনো টাকা বকেয়া না থাকলেও জাহাজ মালিকদের কয়েকশ’ কোটি টাকা আটকে রাখা হয়েছে। নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার পর জাহাজ মালিকদের পাওনা আদায়ের ব্যাপারটি মুখ্য হয়ে উঠে।

সূত্র জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজের চলাচল দীর্ঘদিন ধরে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) নিয়ন্ত্রণ করছিল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। ডব্লিউটিসির আওতায় থেকে জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকাল এজেন্ট এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টেরা দায়িত্ব পালন করে। কোন কোন লোকাল এজেন্ট আবার পণ্যের এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসির নিকট প্রয়োজনীয় জাহাজের চাহিদাপত্র প্রদান করেন। ডব্লিউটিসি সিরিয়ালভুক্ত জাহাজ থেকে উক্ত পণ্যের এজেন্টের বিপরীতে বরাদ্দপত্র ইস্যু করেন।

লোকাল এজেন্ট জাহাজের যোগান দেন। ভাড়া পরিশোধ প্রক্রিয়া পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসিকে জাহাজ ভাড়া পরিশোধ করে, ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্টের বরাবরে ভাড়ার টাকার চেক ইস্যু করে। জাহাজ মালিক লোকাল এজেন্ট থেকে ভাড়ার টাকা পেয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় জাহাজ মালিকদের প্রায় সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা গুটিকয়েক পণ্যের এজেন্ট আটকে দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। যা নিয়েই মূলতঃ ডব্লিউটিসির বিরোধের সৃষ্টি। ডব্লিউটিসির অভিযোগ ছিল জাহাজ মালিকদের সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা গুটিকয়েক পণ্যের এজেন্ট আটকে দিয়েছে। যা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরদিকে পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে দেশের শীর্ষ আমদানিকারকেরা তাদের কয়েকশ’ কোটি টাকার জাহাজ ভাড়া আটকে রাখায় তারা তা পরিশোধ করতে পারছে না। আমদানিকারকেরা টাকা প্রদান করলে তারা ডব্লিউটিসি কিংবা জাহাজ মালিকদের পাওনা পরিশোধ করে দেবে। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মাঝে গত ১০ মার্চ নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ আমদানিকারকদের উপস্থিতিতে এক জরুরি সভা আহ্বান করে। উক্ত বৈঠকে দেশের শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীসহ সংশ্লিষ্ট মালিক এবং কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর আমদানিকারকেরা তাদের কাছে জাহাজ ভাড়ার উল্লেখ করার মতো কোন বকেয়া নেই বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। তারা বলেন, আমাদের এটি চলমান প্রক্রিয়া। এক দুই মাসের জাহাজ ভাড়া ২ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বকেয়া থাকে। যা এক দুই মাসের মধ্যেই পরিশোধ করে দেয়া হয়। এটি একটি চেইন। এই চেইনে কখনো ব্যাঘাত ঘটে না। আমদানিকারকেরা বলেন, ডব্লিউটিসির নিয়মানুযায়ী আমরা পণ্যের এজেন্টকে জাহাজ ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। এখন পণ্যের এজেন্ট সেই ভাড়া যদি পরিশোধ না করে নিজেদের ব্যবসাতে খাটায় তার দায় তো আর আমরা নিতে পারবো না।

গতকাল দুইজন শীর্ষ আমদানিকারক দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের কাছে ১/২ শ’ কোটি টাকা আটকে আছে বলে পণ্যের এজেন্ট নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরে হিসেব দিয়েছে। এটা পুরোই আজগুবি। আমরা নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরে আমাদের বালাম এবং ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ দেখিয়ে এসেছি। আমাদের কাছে এক দুই কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এটাকে বকেয়া বলা ঠিক হবে না বলে উল্লেখ করে ওই আমদানিকারক বলেন, একটি বিল দাখিলের পর প্রসেস হতেও কয়েকদিন সময় লাগে। এটাকে আটকে পড়া বলা যাবে না।

বিষয়টি নিয়ে গতকাল নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জাহাজ মালিকদের বকেয়া টাকাগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এটা করতে পারবো ইন শ আল্লাহ। আমরা একটি মিটিং করেছি। সেখানে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা ছিলেন। আমদানিকারকেরা বলেছেন, তাদের কাছে জাহাজ ভাড়ার কোন টাকা বকেয়া আটকে নেই। ২ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিল বকেয়া রয়েছে।

ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, এতে পরিস্কার হয়ে যায় যে, আমদানিকারকেরা জাহাজ ভাড়া প্রদান করে দিলেও পণ্যের এজেন্টেরা তা পরিশোধ করেন নি। এই টাকা উশুল করার একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে বলেও ক্যাপ্টেন সাব্বির আহমেদ মন্তব্য করেন।

নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমদানিকারকদের অনেক কষ্ট। তাদের বহু ক্ষোভ জমে আছে। বিশেষ করে কোটি কোটি টাকার পণ্য ডুবে বা নষ্ট হয়ে গেলেও জাহাজ মালিকদের অসহযোগিতার কারণে তারা বীমার টাকা পান না। আবার জাহাজ মালিকদেরও অনেক কষ্ট আছে। বিষয়টি আসলে জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকের। এটা তাদেরকেই ম্যানেজ করতে হবে। তাদেরকেই জটিলতাগুলো সমাধা করতে এগিয়ে আসতে হবে।

নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের এই বৈঠকের পর ডব্লিউটিসির বিবদমান দুইটি গ্রুপ জরুরিভাবে বৈঠক করে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে তারা আবারো একই প্ল্যাটফরমে এসে জাহাজ পরিচালনা করার আগ্রহ প্রকাশ করে।

ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে যাওয়া আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, বিবদমান সকল পক্ষকে নিয়ে একটি মিটিং হয়েছে। বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন বিসিভোয়া, কোয়াব এবং আইভোয়াক থেকে ৩ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। এই কমিটি পৃথকভাবে একটি বৈঠক করে। বৈঠকে আইভোয়াকের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দাবি দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে পারভেজ আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত নতুন প্ল্যাটফরমের কমিটিতে ডব্লিউটিসির বর্তমানের কোন নেতৃবৃন্দ থাকতে পারবেন না। ডব্লিউটিসিরি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ করতে হবে। ডব্লিউটিসি নয়, নতুন নামে নতুন স্থানে অভ্যন্তরীণ নৌ পথে পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে।

তবে বিবদমান গ্রুপগুলো এসব শর্ত পাল্টা শর্ত মেনে ঠিক একই প্ল্যাটফরমে আদৌ আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, পিও এমএমডির নিয়ন্ত্রণে খুবই সুন্দরভাবে জাহাজ পরিচালিত হচ্ছে। অনেকেই তাদের জাহাজ সিরিয়ালভুক্ত না করলেও ক্রমান্বয়ে সকলকেই একই সিরিয়ালভুক্ত হয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা অনুসরণ করেই জাহাজ পরিচালনা করতে হবে।

উল্লেখ্য, লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের সদস্যদের মালিকানাধীন প্রায় ১৮শ লাইটারেজ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অন্তত ৩৬টি নৌ রুটে পণ্য পরিবহন করে। এসব জাহাজ বছরে প্রায় ১০ কোটি টন পণ্য পরিবহন করে। দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টর নিয়ে গত বেশ কিছুদিন ধরে অস্থিতরতা বিরাজ করছে। বিবদমান গ্রুপগুলোর কারণে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাওয়ার শংকায় সরকারের নির্দেশে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদের নেতৃত্বে পণ্য পরিবহন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৬ মাস পর পুকুরে ডুবে মারা গেল বোন
পরবর্তী নিবন্ধনাফ নদীর ওপারে ফের বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ