১৯ বছর আগে গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিচারপতি মো. ইমান আলীর ভার্চুয়াল আদালত বেঞ্চ আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় দেন। একই সাথে ১২ বছর আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের করা ক্রিমিনাল আপিল ও জেল পিটিশন খারিজ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আলমগীর কবির রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল (নং-৭/২০০৮ ইং) করেন। এর আগে ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি তসলিম উদ্দিন মন্টু ও মোহাম্মদ আজম জেল পিটিশন করেন। উভয় শুনানিতে আপিল বিভাগ গতকাল এই রায় দিয়েছেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত গতকাল আজাদীকে বলেন, যারা এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের বিচার চান, তারা মনে করেন, ডেথ সেনটেন্স ইজ অনলি পেনাল্টি। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। এখানে আপিলেট ডিভিশনের রায়ে কিন্তু আসামিদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এই রায়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আসামিদের কারাগারে রাখার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এই রায়ে কারোর অসন্তুষ্ট হওয়ার, ক্ষুদ্ধ বা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এর মাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়া গেছে। এই রায়ের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ড আর আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিষয়টি কনসেপ্টের দিক থেকে দেখলে এক। অনেকে আমৃত্যু কারাদণ্ডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হিসেবে ধরে নেন। আসলে তা নয়। আমৃত্যু কারাদণ্ড হচ্ছে মৃত্যু না হওয়ার আগ পর্যন্ত আসামিকে কারাগারে রাখা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। যদি আসামিদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসির আসামি যে প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাচ্ছে, তারাও সেই প্রক্রিয়ায় মুক্ত হতে পারে। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়টি পরবর্তীতে আমৃত্যু কারাদণ্ড করার বিষয়টি উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরেন তিনি।
এদিকে রায়ের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন নিহত গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর স্ত্রী উমা মুহুরী। এ সময় তার চোখে-মুখে দেখা যায় হতাশার ছাপ। আপিল বিভাগের রায়ের পর জামালখান এলাকায় তাঁর বাসায় ভিড় করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের অনুরোধের পর তিনি বলেন, আদালতে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল ছিল। এখন যাবজ্জীবন দিয়েছেন। এখানে আমার কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, যার এ রকম হয়েছে, হারিয়েছে, তারাই কেবল জানে কষ্ট কী। এ সময় তাঁর সন্তানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নগরীর জামালখান এলাকায় বাসায় ঢুকে নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরীকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তখন রাস্তায় নেমেছিল।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন অডিট কর্মকর্তা উমা মুহুরী বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে মামলাটি মহানগর হাকিম আদালত থেকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। একই রায়ে আরও চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পায় চারজন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নাছির ওরফে গিট্টু নাছির, মোহাম্মদ আজম, আলমগীর কবির ও তসলিম উদ্দিন মন্টু। যাবজ্জীবন দেওয়া হয় সাইফুল ইসলাম, মো. শাহজাহান, মহিউদ্দিন ওরফে মহিন উদ্দিন (পলাতক) ও হাবিব খানকে (পলাতক)।
রায়ে খালাস পান নাজিরহাট কলেজের অধ্যাপক মো. ইদ্রিছ মিয়া চৌধুরী, অধ্যাপক মো. জহুরুল হক, অধ্যাপক তফাজ্জল আহম্মদ ও দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার নাসির। আসামিদের মধ্যে সাইফুল ২০০৪ সালে নিজ বাসায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে এবং গিট্টু নাছির পরের বছর র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। ২০০৬ সালের ১৭, ১৮ ও ১৯ জুলাই হাই কোর্ট ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির ওপর রায় দেন। এতে আজম, আলমগীর কবির ও তছলিম উদ্দিন মন্টুর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।