সাগরে হারিয়ে গেল দুই পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন

দুই মাঝির মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া

কল্যাণ বড়ুয়া, বাঁশখালী প্রতিনিধি | সোমবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চল শেখেলখীল ইউনিয়নের অধিকাংশ লোকজনের জীবন ও জীবিকার একমাত্র ভরসা বঙ্গোপসাগর। এখানকার জেলেরা সাগরে মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে কখনো ঝড়বৃষ্টি, কখনো জলদস্যুদের কবলে, কখনো প্রাকৃতিক সৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েন। বিগত দিনে অসংখ্যবার জলদস্যুদের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক জেলে। তারই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার গভীর রাতে আল্লাহ মালিক নামে একটি ফিশিং বোট শেখেরখীল কক্সবাজারের ইনানী সাগর এলাকায় প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।

এর আগে শেখেরখীল ফাঁড়ির মুখ থেকে বোটটি বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জন্য রওয়ানা দেয়। এটি শেখেরখীল ইউপির মেম্বার আব্দুল খালেকের মালিকানাধীন। এটিতে ১৭জন মাঝিমাল্লা ছিলেন। এর মধ্যে ১৪ জন কোনো রকম জীবন নিয়ে ফিরে আসেন। নিখোঁজ হন ওই বোটের মাঝি আবদুর নুর, বোটের নায়া মোহাম্মদ হোসেন, নুরুল আমিন। এদের মধ্যে আবদুর নুর ও নুরুল আমিনের বাড়ি বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শেখেরখীল টেকপাড়া এলাকায়। গত শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে আলাদা আলাদাভাবে আবদুর নুর ও নুরুল আমিনের লাশ পাওয়া যায়। পরে তাদের লাশ এলাকায় এনে পৃথক সময়ে জানাযা শেষে মসজিদ ভিটার পাশে জোড়া কবরে তাদেরকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে এলাকায়। এ দুইজেনকে হারিয়ে নিভে যায় দুই পরিবারের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

দক্ষ একজন মাঝি ছিলেন আবদুর নুর (৩৫)। দীর্ঘদিন ধরে সাগরে ফিশিং বোট নিয়ে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা তার। সেদিনের ঝড়ের কবলে প্রাণ হারাতে হলো তাকেও। আবদুর নুর শেখেরখীল টেকপাড়ার খালেদা বাপের বাড়ির আবদুল আজিজের পুত্র। ৬ বছর আগে তার সাথে বিয়ে হয় রুবি আক্তারের সাথে। তিন সন্তানের জনক আবদুর নুর। প্রথম কন্যা সন্তান জন্নাতুল মাওয়ার বয়স ছয় বছর, দ্বিতীয় কন্যা সন্তান জান্নাতুল নাঈমের বয়স আড়াই বছর। সর্বশেষ তার ঘরে জন্ম হয় পুত্র সন্তান মো. মাসুম। মাসুমের বয়স সবেমাত্র ১০ মাস পার হল। মাসুম জন্ম থেকেই হার্টের (হৃদরোগ) রোগী। তাকে করাতে হবে বড় চিকিৎসা। বাবা নেই। কে করাবে তার চিকিৎসা, কে ধরবে তার পরিবারের হাল। বাচ্চারা কাকে গলা জড়িয়ে বাবা বলে ডাকবে এমন আত্মচিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলে যাচ্ছেন আব্দুন নুরের স্ত্রী রুবি আক্তার– ‘বঙ্গোপসাগর আমার স্বপ্ন কেড়ে নিলো, কেড়ে নিলো আমার পরিবারের আলো। আমরা কি নিয়ে বাঁচবো, কাকে নিয়ে বাঁচবো’। রুবির এমন আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে আসে এলাকার আকাশবাতাস।

বোটের নায়া নুর আমিন (৪৫)। তিনিও মাছ আহরণ করতে খালেকের একই বোটে পাড়ি দেন বঙ্গোপসাগরে। নিখোঁজ হওয়া তিনজনের একজন তিনি। একই এলাকার শেখেরখীল টেক পাড়া সিরাম্মদের বাড়ির ছৈয়দ নুরের পুত্র। তিনিও তিন সন্তানের জনক। তার বড় মেয়ে সাদিয়া শেখেরখীল ইসলামীয়া দাখিল মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ছে। দুই ছেলের মধ্যে শাকিব শেখেরখীল ইসলামীয়া দাখিল মাদরাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট সন্তান রাকিব পার্শ্ববর্তী এলাহী বক্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তাদের বাবাকে হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা। পরিবারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। থেমে যেতে পারে তাদের পড়ালেখা। একটিমাত্র দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়লো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রমাণ পেলেই ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধনবীজি হলেন উত্তম আদর্শের শাশ্বত প্রতীক