একটি সাক্ষাৎকার বই ‘পেয়ারার সুবাস’। সাক্ষাৎকার বই যেন পূর্ণ জীবনী গ্রন্থের আমেজ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর বন্ধু, কলম্বিয়ার সাংবাদিক- ঔপন্যাসিক প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দোজার সঙ্গে মার্কেজের কথোপকথন ও শেষ সাক্ষাৎকার। ইংরেজিতে বইটি ঋৎধমৎধহপব ড়ভ এঁধাধ নামে পরিচিত। খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের এর প্রাণবন্ত অনুবাদে তৃপ্তি নিয়ে পড়লাম।
১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের পথচলাটা শুরুর দিকে অত মসৃণ ছিল না। নানা, নানীর কাছে বড় হওয়া মার্কেসের লেখক সত্তা তৈরির পেছনে অবচেতন মনে নানা আর নানিই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। মার্কেসের নানি তাকে পাঁচ বছর বয়স থেকেই রাতে গল্পের ছলে মৃতদের কাহিনী শোনাতেন। সে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো। মৃতদের মধ্যে ছিল তার নিজের ফুফু, চাচারা। তার জাদুবাস্তবতার গল্প লেখার পেছনে নানির সেই ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টির আমেজটা রয়ে গেছে। নানা, নানির সঙ্গে কাটানো শৈশবের সেই দিনগুলিই বড়বেলায় এসে বৃহৎ ক্যানভাসে রূপান্তরিত হয়, শতবর্ষের একাকীত্ব, মোড়লের শরৎ, পত্রঝড়, কেউ লেখে না কর্ণেলকে এই সব বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাসে।
নিজের মাকে নিয়ে বলা কথাটা বেশ মজার লাগলো।
‘শত বর্ষের একাকীত্বয় উরসুলা ইগুয়ানরানের কিছু কিছু প্রতিকৃতি আমার মায়ের মতো। … মাকে যেমন দেখেছি, অবিকল সেভাবেই গড়তে চেয়েছি ওই চরিত্র এবং সেজন্য ওই চরিত্রের নামকরণও হয়েছে মায়ের নামেই। নিজের ডাকনাম ব্যবহার করতে দেখেই কেবল মা একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হায় খোদা, সারা জীবন ওই জঘন্য নামটা রেখেঢেকে কাটালাম, আর এখন দেখো, সারা দুনিয়ার সব কটি ভাষায় নামটা চালু হয়ে যাচ্ছে।’
এরকম অনেক মজার আমেজ আছে পুরো সাক্ষাৎকার জুড়ে।
টাইপরাইটারে লিখতেন মার্কেস। ইলেক্ট্রিক টাইপরাইটার। লেখালেখির ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে থাকায় বারো পৃষ্ঠার একটা গল্প লিখতে তার পাঁচশ তা পর্যন্ত কাগজ নষ্ট করতে হয়েছে। কোনো শব্দ ভুল হলে কিংবা মনঃপূত না হলে আগের সমস্ত পাতা বের করে আবার নতুন করে কাগজ দিয়ে শুরু করতেন।
নিজের সাহিত্য অনুরাগের পেছনে বাবার ভূমিকাই বেশি বলে মনে করেন মার্কেস। তার বাবা ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, ‘হাতের কাছে যা পান, বাবা তা-ই পড়েন, তা সে সেরা সাহিত্যই হোক, রাজ্যের সংবাদপত্র-পত্রিকার বিজ্ঞাপনই হোক, কি রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার-বিধিই হোক।’
শতবর্ষের একাকীত্ব কিংবা নিঃসঙ্গতার একশ বছর যা ইংরেজিতে ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’ নামে পরিচিত এই বইটিসহ মার্কেসের বেশিরভাগ রচনাই আত্মজীবনীমূলক। তার লেখায় উঠে এসেছে তার শৈশব, কৈশোরের দিনগুলোর কথা। আরাকাটাকা শহরটাকেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে।
লেখক হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন মার্কেসের নানি-মা। তার নানি-মা এমনভাবে গল্প বলতেন, যেন গল্পের ঘটনাটা কিছুক্ষণ আগেই তার চোখের সামনে ঘটেছে। ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটা পড়ে সতেরো বছর বয়সে মার্কেসের মনে হয়েছিল তিনিও লেখক হতে পারেন। কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটিকে অবিকল তার নানি-মার গল্প ভঙ্গির মতো মনে হয়েছিল। কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ কিংবা ‘রূপান্তর’ পড়ার পরই মার্কেস ঠিক করেন যত নামকরা উপন্যাস আছে সব তিনি পড়ে ফেলবেন।
তবে তার রচনাশৈলী গঠনের ক্ষেত্রে ফকনার এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন মার্কেস। যেমন তিনি বলেন,… ‘হেমিংওয়ে অনেক কিছু শেখান। এমনকি একটা বেড়াল কেমন করে বাঁক ঘোরে, তা-ও দেখতে শেখান।’
‘উপন্যাস এবং কবিতা ছাড়া আর কী পড়েন?’ প্রশ্নকর্তা মেন্দোজার প্রশ্নের জবাবে মার্কেসের উত্তরটা কী চমৎকার! ‘গাদা গাদা বই, যেগুলো সাহিত্যিক মূল্যের চেয়ে তাৎক্ষণিক দলিলি মূল্যের জন্যই বেশি পরিচিত। যেমন নামি লোকের স্মৃতিচারণা, যদিও তাতে মিথ্যা জারিজুরি ভরা থাকতে পারে এবং জীবনী ও প্রবন্ধ।’
মার্কেসের সাহিত্য জীবনের সাফল্যের নেপথ্যে স্ত্রী মার্সেদেসের ভূমিকার কথা বারবার বলেছেন। মার্কেস যখন বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘শতবর্ষের একাকীত্ব’ লিখছিলেন তখন স্ত্রী মার্সেদেসের হাতে ছয় মাসের সংসার খরচ গুঁজে দিতে নিজের পছন্দের গাড়িটি বিক্রি করে দেন। শতবর্ষের একাকীত্ব লিখতে সময় লেগেছিল দেড় বছর। বাকি এক বছর সংসারটা মার্সেদেস একাই চালিয়ে নিলেন মার্কেসকে কোনো যন্ত্রণা না দিয়েই। কসাইকে বলে মাংস জোগাড় করেছে, রুটিওয়ালাকে বলে রুটি জোগাড় করেছে, বাড়িওয়ালাকে বাড়ি ভাড়ার দেয়ার জন্য নয় মাস অপেক্ষা করিয়েছে, আবার মার্কেসের লেখার জন্য পাঁচশ তা কাগজও জোগাড় রেখেছে সবসময়। আর পরবর্তীতে ‘শতবর্ষের একাকীত্ব’র সাফল্যগাঁথা নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই।
মার্কেসের সাহিত্য জীবনের নেপথ্যের এই গল্প পড়ে ভাবছিলাম সাহিত্য জগতে এমন কোনো নারী কী আছেন যার সাফল্যের পেছনে ঘরের মানুষটির এরকম উজ্জ্বল ভূমিকা আছে? যিনি ঘর, সংসার, সন্তান সব সামলিয়ে তার স্ত্রীকে নিবিড়ভাবে সাহিত্যের কঠিন পথ পাড়ি দিতে নিজ হাতে নিরবে লন্ঠন ধরে আছেন!
মার্কেসের ‘পত্রঝড়’ নামে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল প্রকাশকের অভাবে। আর্জেন্টিনার এক প্রকাশকের কাছে তিনি পান্ডুলিপি পাঠান। সেই প্রকাশনা থেকে তার পান্ডুলিপিটি ফেরত পাঠানো হয়, সঙ্গে স্প্যানিশ সমালোচক গুইলার্মো দ্য তরের একটি চিঠিও পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে গুইলার্মো তাকে পরামর্শ দেয়, যেন মার্কেস লেখা ছেড়ে অন্যকিছুতে মন দেয়।
এই অংশটা পড়ে চমৎকার অনুভূতি হলো। অনেকে সমালোচকদের কথায় ঘাবড়ে যান। তারা মার্কেসের সাক্ষাৎকারের এই অংশে এসে নিশ্চিত ভাবে প্রেরণা পাবেন।
তার সাংবাদিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বদের সাথে বন্ধুত্ব, যশ, খ্যাতি, সব প্রসঙ্গেই কথা বলেছেন এই সাক্ষাৎকারে। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো মার্কেসের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তবে এই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয় কিন্তু সাহিত্যের মাধ্যমেই।
একটা সাক্ষাৎকার বই এত বিশদভাবে জাদুবাস্তবতার গুরু গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে যা একশব্দে বলতে গেলে বলতে হয় অসাধারণ! বইয়ের শেষ দিকে বিভিন্ন বয়সী মার্কেসের স্থিরচিত্রগুলোও চমৎকার সংযোজন। ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলের নিকটবর্তী শহর আরাকাটাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল মেক্সিকো শহরে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মার্কেস।
অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের প্রতি বিশাল ধন্যবাদ মার্কেসের এই অসাধারণ সাক্ষাৎকারটি আমাদেরকে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
বইটির প্রকাশক প্রথমা। প্রচ্ছদ করেছন মাসুক হেলাল।