ফাতেমা, কাইয়ুম, সাকিব, কামাল, জেসমিন এবং রিফাত। তারা ছয় বন্ধু। সবার বয়স আনুমানিক ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। গায়ের ময়লা জামা দেখেই বুঝা যায় ধুলোবালির জীবন তাদের। পথেই তাদের ঘরবাড়ি। গতকাল বৃহস্পতিবার তাদের দেখা মিলে বইমেলায়। দলবদ্ধভাবে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ছুটছে তারা। কৌতুহল নিয়ে মলাট উল্টে দেখছিল সাজিয়ে রাখা নতুন বই।
পরিচ্ছন্ন জামা পরে মেলায় আসা পাঠকের পাশে তারা বেমানান। তাই এক বিক্রয়কর্মী চলে যেতে বলে ওদের। তখনি প্রতিবাদের সুরে সাকিব উত্তর দেয়, অন্যরা দেখতে পারলে আমরা কি দোষ করছি?
সাকিবের উত্তরেই যেন ধরা দেয় বইমেলার আসল সুর। সব শ্রেণির পাঠকের জন্য উন্মুক্ত এর দরজা। যার সত্যিকার প্রতিফলন ঘটে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলা অমর একুশে বইমেলায়।
গতকাল ছিল মেলার দ্বিতীয় দিন। প্রথমদিনের চেয়ে পাঠক, লেখক, এবং দর্শনার্থীর ভিড় বেশি ছিল এদিন। প্রথম দিনের চেয়ে বিক্রি বাড়ার কথাও জানান তারা। বন্ধের দিন হওয়ায় আজ শুক্রবার মেলা পুরোদমে জমবে বলেও আশাবাদী তারা। আজ সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে মেলা। গতকাল বইমেলা মঞ্চে ছিল কবিতা উৎসব। এদিন স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবিরা।
উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি আসাদ মান্নান। প্রধান বক্তা ছিলেন দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চের সম্পাদক সৈয়দ উমর ফারুক। কবি ওমর কায়সারের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু।
বক্তব্য রাখেন ড. আবদুল্লাহ আল মামুন, কাউন্সিলর মোহাম্মদ সলিম উল্ল্যাহ, নুরুল আমিন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর আনজুমান আরা, হুরে আরা বেগম এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক আবদুল হালিম দোভাষ।
আসাদ মান্নান বলেন, জেলার কবিরা সাধারণভাবে প্রচারের আলোর বাইরে থাকেন। কিন্তু বাংলা কবিতায় তাঁদের অনেকেরই উল্লেখযোগ্য অবদান আছে।
সৈয়দ উমর ফারুক বলেন, ইতিহাসের এক ভয়ংকর দুঃসময়ে কবিরা স্বৈরাচারী দুঃশাসন ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা আজ এক অনুস্মরণীয় মহান ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন প্রকাশনা স্টল ঘুরে দেখা গেছে, এবার প্রকাশিত প্রচুর বই এসেছে গতকাল।
অক্ষরবৃত্তের বিক্রয়কর্মী আবরার ফাইয়াজ বলেন, আমাদের প্রকাশনা থেকে ৬০ টি বই বের হবে। মেলায় ইতোমধ্যে ২০টি আসছে। বাকিগুলো দুয়েকদিনের মধ্যে চলে আসবে। বিকিকিনি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, বেশ ভালই হচ্ছে। খড়িমাটির মনিরুল মনির বলেন, ৪০টি প্রকাশ হবে। ইতোমধ্যে ২০টি চলে এসেছে। বিকিকিনি এখনো জমে উঠেনি বলে জানান তিনি।
আবির প্রকাশনের স্বত্তাধিকারী নুরুল আবছার বলেন, ৩০টি নতুন বই বেরিয়েছে। তবে মেলায় এখনো ধুলোবালি থাকায় আয়োজকদের বিরুদ্ধে বাজে ব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বিক্রিও তেমন বাড়েনি। আগামীকাল (আজ) মানুষজন বাড়তে পারে। বাতিঘর এর বিক্রয়কর্মী বাবলু চৌধুরী বলেন, বিক্রি অল্প হচ্ছে। শুক্রবার বাড়তে পারে।
শিশুপ্রকাশ এর আরিফ রায়হান বলেন, অনেকগুলো স্টল এখনো গুছানো অবস্থায় আছে। দুইদিনে বিকিকিনি অল্প হয়েছে। আশা করছি আগামীকাল (শুক্রবার) জমজমাট হবে। শিশুপ্রকাশ থেকে এবার ৩২টি বই বেরিয়েছে বলেও জানান তিনি।
মেলায় আসা পাঠক মুনিরুল হুদা বলেন, আগের চেয়ে আয়োজন ভালো হচ্ছে। অনেকগুলো প্রকাশনা আসছে। গুছানো আয়োজন। তবে বাংলা একাডেমিসহ ঢাকার নামকরা আরো কয়েকটি প্রকাশনার স্টল থাকলে ভালো হত।
গতকাল পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা বইগুলো মধ্যে রয়েছে এজাজ ইউসুফীর ‘আমার সকল কথা’, সেলিনা শেলীর ‘ছেঁড়া জিবের দাস্তান’, সাজিয়া আফরিনের ‘অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই’ এবং রুমি চৌধুরীর ‘মখমলি গোধূলি’, সাইয়িদ মাহমুদ তসলিমের ‘তারুণ্য উদ্ভিদ বিদেশি ফুল’, সনতোষ বড়ুয়ার ‘আমিও পুলিশ ছিলাম’, মো. আতাউর রহমানের ‘সফলতার জন্য অভিজ্ঞতা’, আলী আসক’র ‘রমণীরা’, ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিনের ‘আমাদের নজরুল’, মিনহাজুল ইসলাম মাসুমের ‘সেলিব্রিটি’।
গতকাল শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘বিচিত্রা সেনের প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগিয়া উঠিল প্রাণ’ এবং প্রজ্ঞালোক প্রকাশনীর প্রকাশিত চাঁদ সুলতানা নকশীর কাব্যগ্রন্থ ‘মিলনান্ত নীল’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
উল্লেখ্য, মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করবেন।
সম্মিলিত উদ্যোগে এবারের মেলাটি চতুর্থ আয়োজন। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলায় ১০৮ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১৪০টি স্টল রয়েছে। এর মধ্যে ডাবল স্টল ৩২টি এবং সিঙ্গেল স্টল ৭৬টি। মেলা প্রাঙ্গণের আয়তন এক লক্ষ দুই হাজার ৩০০ বর্গফুট।












