আমাদের চট্টগ্রামেরই একজন দানবীর, সমাজহিতৈষী কিউসি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী যিনি কোনো প্রচার প্রচারণার তোয়াক্কা না করে তাঁর সমগ্র জীবন মানুষের কল্যাণে তাঁর অর্জিত বিত্তের এক বিপুল অংশ ব্যয় করে এক বিরাট নীরব জনগোষ্ঠীর অন্তরে চিরদিনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী শুধু একজন মানুষের নাম নয়, সময়ের পরিক্রমায় তিনি এক বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। অত্যন্ত প্রচার বিমুখ এবং কিছুটা লাজুক প্রকৃতির এই মহৎ মানুষটি সবসময় প্রচার মাধ্যমের আড়ালেই রয়ে গেছেন। চট্টগ্রামের পাঁচটি উপজেলা, যথা: রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, কর্ণফুলী, আনোয়ারার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই সিংহ হৃদয়ের অধিকারী সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিজ হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। তাঁর গড়া এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দুটি ডিগ্রি কলেজ, পাঁচটি হাই স্কুল, দুইটি কিন্ডারগার্টেন, সাতটি প্রাইমারী স্কুল, দুইটি এতিমখানা, একটি দাতব্য মাতৃসদন, বিনা ভাড়ায় সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য একটি কমিউনিটি হল, তিনটি হাই স্কুলে তিনটি অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ভবন, তিনটি প্রতিষ্ঠানে তিনটি লাইব্রেরী সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিপুল সংখ্যক মসজিদ, মাদ্রাসার উন্নয়নে এবং চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ও এসবের উন্নয়নে রয়েছে তাঁর বড় অংকের আর্থিক অনুদান। এ সকল কাজে তিনি মুক্ত হাতে ব্যয় করেছেন বিপুল অংকের টাকা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে তিনি কখনো প্রচারণার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। আত্ম প্রচারণাকে তিনি আজীবন এড়িয়ে চলেছেন আর থেকেছেন রাজনীতি থেকে শতযোজন দূরে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে দুঃখী ও অভাবী মানুষের জন্য তিনি আজীবন ছিলেন নিবেদিত। দুস্থ, অভাবী, কন্যাদায়গ্রস্ত ব্যক্তি এবং রোগাক্রান্ত মানুষের মাথার উপর তিনি ছিলেন নিরাপত্তার ছাতার মত। প্রচার বিমুখ স্বভাবের কারণে সমাজের কল্যাণে এই বিশাল অবদানের কথা অনেক মানুষের জানার বাইরে রয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সমাজ সেবার এক নিরব কারিগর।
আত্ম প্রচারের বা নাম কুড়াবার জন্য নয়, পেশাগত শত ব্যস্ততার মাঝে চরম ধৈর্য ও পরম মমতায় তিনি এসব প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি ধূলিকণায় রয়েছে তাঁর স্পর্শ। এ সকল প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ অনুপম ঐতিহ্য ও গৌরবের অধিকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নগরীর অনেক নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে তাঁর গড়া এ সকল প্রতিষ্ঠান আজ অনন্য সাধারণ ও অভিজাত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের জনক সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী আজ এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তাঁর নিজ হাতে গড়া এসকল প্রতিষ্ঠান তাদের সেবাধর্মী কাজের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদানের গৌরবের পতাকা উড্ডীন করে রেখেছে।
বিপুল বিত্ত–বৈভবের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে ছিল না কোনো অহংবোধ আর ছিল না ধনী–নির্ধনের সাথে তাঁর আচরণে কোন পার্থক্য। তিনি তাঁর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের খোঁজ নিতেন। বই পড়া আর গান শোনা ছিল তাঁর নেশা। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন লেখকের প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ সম্বলিত তাঁর রয়েছে একটি বিরাট ব্যক্তিগত লাইব্রেরী। তিনি ছিলেন ক্রিকেট খেলার একজন ভক্ত। বিশ্ব রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। সংস্কৃতিমনা এই মানুষটির রয়েছে গানের বিপুল সংগ্রহ। তিনি যখন চট্টগ্রামে অবস্থান করতেন তখন প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তিনি তাঁর অত্যন্ত কাছের বিভিন্ন ব্যক্তিদের তাঁর গুডস্ হিলস্থ বাসভবনে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তাঁদের সাথে সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয় ও বিশ্ব রাজনীতি সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠতেন। তালাত মাহমুদ, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, সামসাদ বেগম, লতা, আশা ভোঁসলে, রুনা লায়লা, সাবিনা, সৈয়দ আবদুল হাদি, শাহ আবদুল করিম, হাসান রাজা প্রমুখ শিল্পীর গান ছিল তাঁর অত্যন্ত পছন্দের।
তাঁর মত ক্ষণজন্মা এই মহান মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই। রাজনীতিতে যোগদান করে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভের মত প্রস্তাব তিনি একাধিকবার সরিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল নির্লোভ, নিরহংকারী, প্রচার বিমুখ, সাদা মনের এই মহৎ প্রাণ মানুষ সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর জীবনাবসান হয়। আজ তাঁর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। জনকল্যাণ ও সমাজকল্যাণে নিবেদিত মানুষের তালিকায় লেখা রবে তাঁর নাম। তাঁর স্মৃতি প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও প্রাবন্ধিক।