‘বুড়িমা, জীবন স্রোতস্বিনী নদীর মতো বহমান। সেই ধারায় আবর্জনা বা খড়পাতার মতো ভেসে না গিয়ে বরং দক্ষ নাবিকের মতো জীবন নামক জাহাজটিকে নিজের গন্তব্য কিংবা তীরে পৌঁছানোর জন্য যথাসাধ্য সাধনা করে যেতে হবে। সে সাধনা কিন্তু সহজ নয়, বন্ধুর। প্রতিকূলতা ঘাতপ্রতিঘাত সকল কিছুর সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। সংসারের ঘানি টানতে টানতে ভুলে গেলে চলবে না নিজের অস্তিত্বকে। আর নিজের সত্তাকে তখনই উপলব্ধি করতে পারবে যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে জ্ঞান সাগরের জল পান করতে চাইবে, জ্ঞানসাগরের জল যেন শুধু জল নয়, এ এক অমৃতের ভাণ্ডার।’ বিয়ের পরদিন আমার প্রতি আমার পরমপূজ্য শ্বশুরের উপদেশসমূহের একটি অংশ ছিল এটা। তাঁর মাতার নাম ও আমার বাবা দীপক চৌধুরীর আদরে প্রদত্ত ডাকনাম একই হওয়াতে তিনি আমাকে ‘বুড়িমা’ বলে সম্বোধন করতেন গভীর স্নেহে।
তাঁর লেখার প্রচণ্ড রকমের ভক্ত ছিলাম বলে কোন নতুন লেখা শেষ করলেই তিনি তা আমাকে পড়ে শোনাতেন। তারপর শ্বশুর আর পুত্রবধূতে মিলে সেই লেখাকে কেন্দ্র করে আমার আর তাঁর নিজের লেখাকে নিয়ে নিজেই আবার মন্তব্য করতেন। খুব সুন্দরভাবে আমার বিয়ের পরবর্তী সময়গুলো কেটেছে। সেই সময়ে যখন পত্রপত্রিকায় পড়তাম বা আশপাশে শুনতাম শ্বশুরগৃহে পুত্রবধূর নির্যাতনের কাহিনি তখন রীতিমতো কষ্ট পেতাম, অবাক হতাম। প্রশ্নবাণে নিজের বিবেককে জর্জরিত করতাম। কেন পৃথিবীর সব শ্বশুর আমার শ্বশুরের মতো হয় না? যদি হত তাহলে যৌতুকের মতো জঘন্য বিষয়ের কারণে সংসারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের জের ধরে আর কোন নিষ্পাপ মেয়েকে অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হত না। সে তার সম্ভাবনাময় জীবনের পাখা মেলে বিশাল আকাশে উড়ে বেড়াতে পারত। এমন অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যারা কেবল নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভাষণ দিয়েই ক্ষান্ত হন। কতটুকু প্রয়োগ তাঁরা তাঁদের নিজের জীবনে করেন? কিন্তু আমার শ্বশুর বিমলেন্দু বড়ুয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভিন্ন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের জীবনে তথা আত্মীয় পরিমণ্ডল, সমাজ সর্বত্রই স্নেহমায়া–মমতা–ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে সকল নীচতা–হিংসা–নির্যাতনকে জয় করার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন আমৃত্যু।
একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরে তিনি আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান নিয়ে উপবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। তার কারণ হল–আমাদের সমাজব্যবস্থায় এমন এক রীতির প্রচলন রয়েছে পুরুষ ও মহিলা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর স্বামীর নাম বা পদবি স্ত্রীর নামের সাথে সংযুক্ত করা ও সাথে সাথে স্ত্রীর নিজের বা পরিবারের পদবি ছিন্ন করা। বিভিন্ন যুক্তিযুক্ত কারণে একটি পরিবার থেকে কন্যাদের জন্য আরেক পরিবারের কন্যাদের একই রীতিতে পরিবারের সদস্য করে একটি সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়ে আসছে। কিন্তু এর মানে এই হতে পারে না আমার গৃহে সারা জীবনের জন্য সে আসছে বলে তার পিতামাতার প্রদত্ত নাম বা পদবিটিকে পাল্টে ফেলতে হবে। আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী নই। সবার আগে আমার জন্মসূত্রে
প্রাপ্ত নামে আমি নিজেকে চিনেছি, পরে অন্যকিছু। তাই আমি আমার নাম বিয়ের পরবর্তী সময়েও পূর্বের মতোই লিখতাম। তাতে আমার শ্বশুর আমার মতের সাথে জোরালো একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত ও তীক্ষ্ণ উত্তর দিয়েছেন প্রশ্নকর্তাদের প্রতি। এতে তাঁর মাঝে সমাজের জীর্ণ গোঁড়া বা বলপূর্বক–চাপিয়ে–দেওয়া নীতি সংস্কারপূর্বক সমাজকে একটি নিরপেক্ষতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
তাঁর গুণের মাঝে আর্তপীড়িতের সেবায় নিয়োজিত থাকার প্রবল ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয়। যেমন ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেডক্রসের সহায়তায় তিনি তাঁর গ্রামসহ বহু জায়গায় নিজ হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্তমানবতার সেবার রত ছিলেন। শুধু তাই নয়, এর পরবর্তী সময়ের তিনি নানাভাবে দুঃখদুর্দশা হতে মানুষকে রক্ষা করার জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ করানো, সরকারি সহায়তায় ও মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লক্ষ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করানোসহ নানাবিধ সমাজিক কর্ম আজীবন করে গেছেন। তিনি দক্ষ সংগঠক ও আদর্শ নেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনের বহু প্রতিকূলতার মাঝেও। দক্ষ সংগঠক ও নেতা হিসেবে বিদেশেও যে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে আছে তা আমি জানতে পারি যখন আমি নিজে প্রবাসে বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগঠনের সাথে মিশেছি ও সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের সাথে আমার শ্বশুরের আলাপচারিতা শুনেছি, দেখেছি। কেবল বাইরের পরিমণ্ডলেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তা নয়, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন সার্থক পুত্র, ভ্রাতা, স্বামী, জামাতা, পিতা, শ্বশুর। কোনো দায়িত্বকেই তিনি এড়িয়ে চলেননি কখনও।
তাঁর কথা ছিল ‘জীবন যেখানে যেমন সেখানে তেমন করে তোলা’। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে তৈরি করে নিতে হবে যাতে জীবনের খুব স্বাভাবিক প্রতিকূলতাকে পার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। যেমন পানি তরল পদার্থ, যে পাত্রে ঢালা হবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। সেরূপ নিজেকেও সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে চলার মানসিকতা থাকতে হবে। তাঁর এই উপদেশ আমিও পরম শ্রদ্ধার সাথে পালন করার চেষ্টা করি। তাঁর ব্যক্তিগত গুণসমূহ আমার দেখা ও তাঁর সাথে আলাপচারিতার মাঝে খুঁজে পাওয়া আর তাঁর অনেক গুণগ্রাহীর কাছ থেকে শোনা। সবকিছু মিলিয়ে এত অল্প কথায় সবকিছু প্রকাশ করার মতো নয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম এত বড় ও সমৃদ্ধ যে সে সম্পর্কে যে নিজের ভালোলাগার বিষয় লিখব তার সাহস বা ক্ষমতা কোনটি আমার নেই। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি ও শুনি যখন অন্য সাহিত্যিকগণ আমার শ্বশুর বিমলেন্দু বড়ুয়ার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে লেখেন ও আলোচনা করেন। খুব অল্প সময় তাঁকে পেয়েছি। সময় স্বল্প হলেও তিনি আমাকে অনেক কিছুই দান করেছেন–যা আমৃত্যু আমার নিজের চিন্তা ও চেতনায় অত্যন্ত যত্নে লালন করব পরম শ্রদ্ধায়।
লেখক: থাইল্যান্ডের বিখ্যাত মহা চুলালংকরণ রাজা বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত। পারিবারিকভাবে সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার একমাত্র পুত্র ড. সবুজ বড়ুয়া শুভর সহধর্মিণী।