
সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই কৃতিপুরুষ ২০১৩ সালের ২৬ শে অক্টোবর, ইন্তেকাল করেন। অবসরের আগ পর্যন্ত গিয়াস কামাল চৌধুরী বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি দৈনিক খবরপত্রের সম্পাদক ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তায় বলেন; গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাংবাদিকতার ভিত্তি ছিল তার স্বাধীন বিবেক। তার শানিত লেখনিতে তিনি নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। তিনি রাজরোষে পড়ার পরও নির্ভীক চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। আজীবন সরব মানুষটির হঠাৎ নীরব যাত্রার খবরটি যখন পাই– তখন বাংলাদেশের জনমনে চলছে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসহিঞ্চুতা এবং অনেকটাই নাজুক পরিস্থিতি। সাধারণ নাগরিকদের মাঝে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। দেশে যখন কোনো না কোনো নিষ্ঠুর অঘটন ঘটে! কিম্বা গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়লে যে মানুষটি প্রত্যক্ষ রাজনীতিবিদ না হয়েও গণতন্ত্রের স্বার্থে, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে জীবনবাজী রেখে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দলগুলোকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন তিনিই আমাদের প্রাণপ্রিয় অভিভাবক প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। চলনে–বলনে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাণ্ডারী। দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের জন্যে, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের জন্য অতুলনীয় অগ্রপথিক। বাম–ডান সকল পন্থিদের জন্য সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ছিলেন অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস। রাজপথের আন্দোলনে বহু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী নেতৃবৃন্দকে গিয়াস কামাল চৌধুরী সাহেব এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সত্যকে প্রকাশ করাই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে গণতন্ত্রমনা জনগণকে সুন্দর–সহজ–সরল পথের সন্ধান দিতে পারতেন গিয়াস কামাল চৌধুরী। সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী সাহেবের স্মৃতিচারণ করে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৮৭–৮৮ সালের দিকে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। জনগণের স্বাভাবিক কথা বলার সুযোগটুকু যখন হরণ করা হচ্ছিল ঠিক তখনই ১৯৮৮ সালের ২১ অক্টোবর শুক্রবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রাজপথে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংবাদপত্র দৈনিক ইনকিলাব, বাংলার বাণী, ইত্তেহাদ, রোববার, যায় যায় দিন, জয়যাত্রা, বিচিন্তা, খবর ও চট্টগ্রামের ইজতিহাদ সহ সকল পত্রিকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবীতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। রাজপথের এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি এস.এম.জামাল উদ্দিন। স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি আয়োজিত এ সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংবাদিকদেরকে দল–মত–নির্বিশেষে সামাজিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরনটুকু বজায় রাখতে হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পেশাগতভাবে আমি একজন মেহনতী সাংবাদিক। মহত্ববোধ, মমত্ববোধ, মানবতাবোধ প্রতিষ্ঠা করাই বর্তমান সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন দেশ ও জনগণের স্বার্থে। সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী সাহেব আমাদেরকে সে শিক্ষাই দিয়েছেন– যে শিক্ষা মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসতে শিখবে। দল–মতের উর্ধ্বে উঠে কাছে টেনে নিবে। ১৯৮৮ সালের ১৯ শে নভেম্বর শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি আয়োজিত ‘সংবাদপত্র ও পাঠক সমাজ’ শীর্ষক এক সেমিনারে সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী বলেছেন ‘সংবাদপত্র ফুলের বাগান নয়– কাঁটার বাগান। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে যে আন্দোলন চলছে তা আজো অব্যাহত আছে, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চলবে’। তিনি আরো বলেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরংকুশ গণতন্ত্র’। গিয়াস কামাল চৌধুরী সংবাদপত্র জগতে মওলানা আকরাম খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, মজিবর রহমান খা’র মত ব্যক্তিত্বদের অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। দৈনিক খবরপত্রের সম্পাদক থাকাকালীন ২০০৬ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির পক্ষ থেকে সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীকে শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক সম্মাননা স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ২১শে জুলাই ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.ডিগ্রি লাভ করেন। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। ‘ঢাকা টাইমস্’ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ সহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ সাধন এবং পেশার আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। দীর্ঘদিন ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) ঢাকা সংবাদদাতা হিসেবে তিনি ছিলেন অতি পরিচিত। সাংবাদিকতায় অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৬৪ সালে ইত্তেফাক গ্রুপ থেকে প্রকাশিত ঢাকা টাইমস্ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবন শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর শনিবার তিনি ইন্তেকাল করেন। ঐ দিন রাতে তাঁর জন্মস্থান ফেনীতেই চৌধুরী বাড়ির দিঘির পাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। তাঁর ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখক: বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থার কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সভাপতি, স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি










