সাংবাদিকতার ভুবনে যিনি ছিলেন শুকতারা

মুহাম্মদ মহসীন চৌধুরী | রবিবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাদের রুচি ও প্রগতির অভিভাবকত্বে দায়িত্ব পালনে নিজের মননশীলতাকে নিবেদিত রেখেছিলেন। এতে তাঁর চরিত্রের একটি সৃষ্টিশীল দিক আমাদেরকে সহসাসচকিত করে তোলে। তাঁর তিরোধানে সেই সহজলভ্য পাওনা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতির অভাব সম্পর্কে আমাদের চিন্তা প্রকট হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা তাঁর মানসিক প্রক্রিয়াকে অর্জন করতে পারি। এতে তাঁর কর্মময় জীবনের সাথে আমাদের দূরত্ব কখনো হবে না। তিনি অবশ্যই আমাদের মানসলোকে অব্যয় হয়ে থাকবেন।

তাঁর মধ্যে আমরা দেখি বহুমুখী প্রতিভার প্রতিভাস। ৮৩ বছরের জীবনে তিনি সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কর্মকে কখনো অবসরে রাখেননি। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তিনি ঘাটেঘাটেও পাড়ি দিয়েছেন। পক্ষান্তরে সমাজ মনস্কতায় তিনি লোকজঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুসঙ্গে সমাজের পালাবদল চেয়েছেন। ক্রমিক উত্তরণের ধারায় নিজের চিন্তাচর্যাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বৃহত্তর জাতীয় ক্ষেত্রেও লব্ধ প্রতিষ্ঠা ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর জীবনাচারে আমরা শান্তশ্রী স্নিগ্ধতাকে পাই। এটাই তাঁর জীবনবীক্ষণের একটি মহৎ দিক।

তিনি আমাদের কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবন কখনো অন্যের কাছে কোন রূপ ভয়ের উপকরণ ছিল না। তাইতো তিনি ভালোবাসা পেয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন। তিনি রাজনীতি করেছেন। নেতা হিসেবে নেতৃত্বের একটি সুন্দর সংজ্ঞা নিজের জীবনে রূপায়িত করে গেছেন। তিনি ছিলেন খাপে ঢাকা তলোয়ারের মতো। সকল প্রকার বৈপরীত্যের বিরুদ্ধে তিনি সকল সময়ে সজাগ থেকেছেন এবং প্রতিবাদী হয়েছেন। তবে কখনো সংযম ও পরিমিতিবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি তেজী (Sprited) ছিলেন, তবে সেই সংগ্রামে কোন রূপ হিংস্রতা ছিল না। তাঁর জীবন শিল্পে আমরা পাই Plain living and high thinkingকে। তিনি ছিলেন Perfect gentleman. তিনি কখনো নিরাশ হননি। ছিলেন আশাবাদী।

সেই প্রবল আশাবাদের বাস্তবায়নে তিনি এগিয়ে গেছেন। ঝড়ের তান্ডবকে তিনি কখনো ভয় করেননি। তিনি কখনো ভেঙ্গে পড়েন নি। তাঁর কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণে আমরা অনবদ্য চেতনার দার্শনিকভাষ্যকে পাই।

তাঁর বিপুলবিটপী চেতনার শতধারার উৎসারণকে জীবনের পর্বেপর্বে সাজিয়ে গেছেন। সেগুলো উজ্জ্বলউদ্ধারের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। আমাদের উচ্ছাস তো শেষ পর্যন্ত থাকে না, মিইয়ে যায়। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যে আলোকের ঠিকানা দিয়ে গেছেন, সে পরিসরে আমাদের আন্তরিক অনুধ্যান বাস্তবায়নের উপযুক্ততা থাকা উচিত। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিসহ নানাক্ষেত্রে তিনি সফলভাবে বিচরণ করেছেন, তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন আজো আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অধ্যাপক খালেদ ছিলেন প্রগতিশীল চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক ব্যক্তিত্ব। যাঁর মধ্যে ছিল দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতা। তিনি আমাদের প্রতিনিয়ত আলোর পথ দেখাচ্ছেন। তিনি এ অঞ্চলে আলোকিত মানুষ সৃষ্টির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদী’র মত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা করে মানবমুক্তি এবং সমাজকে আলোকিত করার যে পথ দেখিয়েছেন তা ধারণ করতে পারলেই আগামী প্রজন্ম ও আলোকিত প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাঁর সৃষ্টি প্রতিনিয়ত নির্মাণ করছে আমাদের। তিনি একটি উন্নততর নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক সমাজ নির্মাণ অনুকরণীয় সাহস যুগিয়েছেন।

তিনি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেছিলেন পান্ডিত্যের চেয়ে চরিত্রবান লোকের প্রয়োজন বেশী। ফুলের পাঁপড়ির মতো অধ্যাপক খালেদ ছিলেন বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আদর্শের কারণে সফল হয়েছেন। আদর্শের কারণেই তিনি সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাধর প্রার্থী এ.কে.এম ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সংবিধানের প্রণেতা। তিনি তাঁর নিষ্ঠা, সততা ও মেধা দিয়ে দৈনিক আজাদীকে নিয়ে গেছেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল সাফল্যের শিখরে। অধ্যাপক খালেদ কথা বলতেন দৃঢ়ভাবেযার সাথে কাজের সমন্বয় থাকতো। অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন বলেই অধ্যাপক খালেদ কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি আজীবন সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। নতুন প্রজন্মের উচিত অধ্যাপক খালেদের জীবন এবং তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হওয়া। তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক। তাঁর জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রামকে জ্ঞান গরিমায় গড়ে তোলা। তিনি মানবতাবোধের সাথে দেশাত্মবোধ যুক্ত করেছিলেন।

তিনি দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক হিসেবে চল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেছেন। সাংবাদিকতার ভুবনে তিনি শুকতারা হয়ে প্রজ্বলিত থেকেছেন। চেতনার দিগ্‌দর্শন রচনা করেছেন। তাঁর জীবন সুদর্শন কখনো নিঃশেষ হবার নয়। তিনি ১৯৯০ সালে একটি কবিতা রচনা করেন। শিরোনাম ‘আমি শেষ নই’। এ নামটিতেই তাঁর আত্মবিশ্বাস ও অঙ্গীকার প্রকাশিত থেকেছে। তাঁর লেখা ভ্রমণ কাহিনী ‘সৌদী আরবে পঁয়ত্রিশ দিন’ (১৯৯৬) গ্রন্থটিতে তিনি নিজেকে উন্মোচন করেছেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁর মৃত্যুর পর সেই শূন্যস্থান পূরণ হয়নি আজো। বরেণ্য নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদএর ভাষায় ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ একজন সম্পূর্ণ মানুষ’।

লেখক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ : মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রচিন্তা ও বিবেকের রাজনীতি