পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে বর্ণিল সাজে সেজেছে পাহাড়ি জনপদ। পাহাড়ের তিন সমপ্রদায়ের বড় আয়োজনগুলোর একটি ‘সাংগ্রাই’। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মারমা সমপ্রদায়ের এই উৎসবের আনন্দ এখন বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে। গতকাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে সাংগ্রাই উৎসব।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, মারমা সমপ্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব মাহা সাংগ্রাই উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। গতকাল মারমা রীতি অনুযায়ী ১৩৮৭ মঘাব্দ উপলক্ষ্যে খাগড়াছড়িতে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সকালে মারমা ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ মাঠ থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রা আপার পেরাছড়ায় শেষ হয়। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, অলংকার পরে শোভাযাত্রায় যোগ দেয় মারমা তরুণ তরুণীরা। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমি পাহাড়ি ভাইবোনদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে যে সম্প্রীতি রয়েছে তা আরো বেশি সুদৃঢ় করবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক তৈরি করবে।
জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পুরো খাগড়াছড়ি নয়, পুরো পার্বত্য জেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিজু, বৈসু এবং সাংগ্রাইসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর যে উৎসব চলছে তা আমাদের অনুপ্রেরণায় বিষয়। আমরা সকল জাতিগোষ্ঠী একত্রে উৎসবগুলো পালন করছি। এর ফলে একটি সুখী, সৃমদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
মারমা ঐক্য পরিষদের ম্রাসাথোয়াই মারমা বলেন, মারমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, ভাষা ও ইতিহাস রয়েছে। উৎসবের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্বকীয়তা রক্ষার লক্ষ্যে এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ১৮ এপ্রিল মারমা ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে মৈত্রী জল বর্ষণ বা পানি খেলার আয়োজন করা হয়েছে।
শোভাযাত্রায় খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমএন আফসার, মারমা ঐক্য পরিষদের নেতা রুমেল মারমা প্রমুখ অংশ নেন। মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া পৈজিতা মারমা বলেন, সবাইকে সাংগ্রাইয়ের শুভেচ্ছা। আমরা আজকে র্যালিতে অংশ নিতে আসছি। বছরজুড়ে আমরা আজকের এই দিনের জন্য অপেক্ষা করি। আজকে এখানে অংশ নিতে পেরে ভালো লাগছে। র্যালি শেষে আরো বেশ কিছু আয়োজন রয়েছে। এলিচিং মারমা বলেন, আজকে আমরা র্যালিতে আসছি। কালকে আমাদের মূল সাংগ্রাই। র্যালির মাধ্যমে আমরা সাংগ্রাইয়ের শুরু করেছি।
বান্দরবান : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে বান্দরবান রাজারমাঠে বেলুন উড়িয়ে ছয় দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসবের উদ্ধোধন করেন জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি। এরপর সাংগ্রাই শোভাযাত্রার বের করা হয়। শোভাযাত্রায় মারমা, ম্রো, খুমি, খেয়াং, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, বম, লুসাইসহ ১১টি ক্ষুদ্র নৃ–জনগোষ্ঠীর তরুণ–তরুণী, শিশু কিশোর ও বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা নিজস্ব জাতিস্বত্বার পোশাক পড়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। শোভাযাত্রাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে বয়স্ক পূজায় অংশ নেয় মারমা জনগোষ্ঠীর নারী–পুরুষেরা।
উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ–জনগোষ্ঠীদের বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি–সংস্কৃতি বাংলাদেশের সম্পদ। এখানে পাহাড়ের এগারো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালি জাতির সৌহার্দপূর্ণ বসবাস বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আজকের সাংগ্রাই উৎসবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশের যে শুভ সূচনা হয়েছে, আমরা ঐক্যবদ্ধ সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
এ সময় বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবু তালেব, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএসমং, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি চনুমং মারমা, সদস্য সচিব থুইচপ্রু লুবু মারমা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এবার সাংগ্রাই উৎসবে ছয় দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে। আজ সোমবার বুদ্ধমূর্তি স্নান অনুষ্ঠিত হবে। ধর্মীয়ভাবে কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু, শ্রমণ এবং বৌদ্ধ ধর্মালম্বী নারী পুরুষেরা খালি পায়ে দুয়েক কিলোমিটার হেটে সাঙ্গু নদী চরে মিলিত হবে বুদ্ধমূর্তির স্নান অনুষ্ঠানে। কষ্টিপাথরের কয়েকশ বছরের পুরনো বুদ্ধমূর্তিতে পবিত্র জল ঢালা হবে পূর্ণের আশায়।
আগামীকাল মঙ্গলবার রাজারমাঠে ঐতিহ্যবাহী বলী খেলা, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ ও লোকজ ক্রীড়া। চতুর্থদিন বুধবার হবে সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ মৈত্রী পানি বর্ষণ বা জলখেলী উৎসব। রাজারমাঠে বিকাল তিনটায় জলখেলী উৎসব হবে। থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পঞ্চমদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারও অনুষ্ঠিত হবে জলখেলী উৎসব।