সাঁওতাল বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সরকার এবং দেশীয় জোতদার, জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের শাসন শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতালদের একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণসংগ্রাম ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এই বিদ্রোহের রূপকার ছিল সাঁওতালরা। তবে এই সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন যুগিয়েছিল আদিবাসী নয় এমন নিম্নবর্গের অনেক শ্রেণিপেশার মানুষ। সে বছরের ৩০শে জুন এই বিদ্রোহ চরম রূপ নেয়। আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর সাঁওতালরা সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস করে আসছিল। তাদের প্রধান বসতি ছিল সাঁওতাল পরগণায়। নিজস্ব ভাষায় তারা একে বলতো ‘দামিন–ই–কো’। সহজ–সরল জীবন–যাপনে অভ্যস্ত সাঁওতালরা নিজেদের শ্রমলব্ধ ফসল নিজেরাই উৎপাদন করতো। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত বিভিন্ন আইনের ফলে অর্থনীতি সংকটময় হয়ে ওঠে। এর সুযোগে নতুন জেগে ওঠা মহাজন ও ব্যবসায়ী শ্রেণি ফাঁদ পাতে সুদ–দাদন বা মহাজনী ব্যবসার। এর খপ্পরে পড়ে নিরীহ সাঁওতালরা সর্বস্ব হারাতে থাকে। তার ওপর জমি ও ফসল দখল, দৈহিক নির্যাতন, খুন–জখম, সাঁওতাল নারীদের ওপর লাঞ্ছনা চলতেই থাকে। প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েও তারা সুবিচার পায় না। ফলে বিদ্রোহ দানা বাঁধে। বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, ভৈরব ও চান। এদের নেতৃত্বে সাঁওতালরা শপথ নেয় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার। এদিকে সরকার বাহিনী এবং তাদের পোষ্য জমিদাররা সাঁওতালদের ওপর চড়াও হয়। সাঁওতালরা জ্বালিয়ে দেয় জমিদারদের ঘরবাড়ি। বিপদ বুঝে ইংরেজ সরকার সেনাবাহিনি প্রেরণ করে। সাঁওতালদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয় ইংরেজ সেনারা। এরপর ব্রিটিশ সরকার জোতদারদের সহায়তায় ভারাটে সৈন্য ও হাতির দল পাঠিয়ে সাঁওতালদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়। যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। তাদেরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু হার মানে না নিপীড়িত সাঁওতালরা। এ সময় সামরিক আইন জারি করে ব্রিটিশরা কামান ও হাতি সহ বিশাল সৈন্যবাহিনি পাঠিয়ে সাঁওতাল পরগণায় হত্যার তাণ্ডবে মেতে ওঠে। একমাত্র হাতিয়ার তীর ধনুক নিয়ে অসম যুদ্ধে সাঁওতালরা পেরে ওঠে না । ইংরেজ বাহিনির নৃশংস হামলায় সাঁওতাল নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবক অকাতরে প্রাণ হারায়। রক্তে লাল হয়ে যায় সাঁওতাল পরগণার মাটি। সিধু, কানু সহ অসংখ্য বিদ্রোহী মারা যায়। বহুমাত্রিক ও বিবিধ প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রবল দমন নীতির কারণে আপাত ব্যর্থ হলেও যুগ যুগ ধরে সিধু, কানু সহ বিদ্রোহী সাঁওতালরা বাংলায় বিপ্লবী চেতনার প্রতীক হয়ে রয়েছে।